ওয়াজেদুর রহামন কনক


বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস কেবল একটি আন্তর্জাতিক observance নয়; এটি আমাদের জীবনের প্রতিদিনের সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক সচেতনতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গুরুত্বকে জোরালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক অস্থিরতার সময়ে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সঞ্চয় কেবল নিরাপত্তার মাধ্যম নয়, বরং দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নেরও ভিত্তি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ফিনটেক সেবার বিস্তার সঞ্চয় সংস্কৃতিকে সহজলভ্য করেছে। শিশু থেকে প্রবীণ—সকলেই ছোট ছোট সঞ্চয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে এগোতে পারছে। সরকারি সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত, ক্ষুদ্র ঋণ ও উদ্যোক্তা সঞ্চয় কর্মসূচি দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করছে এবং গ্রামের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দৃঢ় করছে।
তিবছর ৩০ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস—একটি দিন, যা মানুষকে অর্থনৈতিক সচেতনতা, পরিকল্পিত সঞ্চয় এবং দায়িত্বশীল ব্যয়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯২৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইতালির মিলানে অনুষ্ঠিত প্রথম International Savings Bank Congress-এ এই দিবস পালনের ধারণা জন্ম নেয়। সম্মেলনে উপস্থিত ২৭টি দেশের প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেন—প্রতি বছর ৩০ অক্টোবর হবে ‘World Thrift Day’। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সঞ্চয়ের অভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা বাড়ানো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে যখন অর্থনীতি পুনর্গঠনের পর্যায়ে, তখন এই দিবসের তাৎপর্য আরও বৃদ্ধি পায়। ইউরোপের বহু দেশে সঞ্চয়কে ‘national duty’ হিসেবে দেখা হতো। যেমন—ইতালিতে পোস্টাল সেভিংস ব্যাংকগুলো গ্রামীণ জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের বার্তা ছড়িয়ে দেয়, আর জার্মানিতে ১৯৫০-এর দশক থেকে “Sparwoche” (Savings Week) নামে জাতীয় কর্মসূচি চালু হয়।

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) ২০২5 সালের অনুমান অনুযায়ী, বৈশ্বিক গড় জাতীয় সঞ্চয় হার (Gross Domestic Savings Rate) প্রায় ২৫.৫%, যেখানে এশিয়ার দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে। চীনের সঞ্চয় হার প্রায় ৪৪%, ভারতের ৩২%, আর বাংলাদেশের ২৮.৩%। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সঞ্চয় হার মাত্র ১৮%, আর যুক্তরাজ্যে প্রায় ১৬%।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিতব্যয়িতা কেবল আর্থিক অভ্যাস নয়, এটি এক সামাজিক ঐতিহ্য। গ্রামীণ সমাজে ‘দিন শেষে কিছুটা রেখে দেওয়া’ বা ‘অতিরিক্ত ব্যয় না করা’ এক সময় পারিবারিক শিক্ষার অংশ ছিল। আজও সেই মনোভাব অনেক পরিবারে টিকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের তথ্যমতে, দেশে মোট ব্যাংক আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬.৫ ট্রিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে প্রায় ৪০% আমানত আসে ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে।

এছাড়া, ডিজিটাল সঞ্চয় ব্যবস্থার বিকাশে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অগ্রগামী দেশ। ২০২৫ সালে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩.৪ কোটি, এবং প্রতিদিন গড়ে ৬,০০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়—যার একটি বড় অংশ ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে আসে। বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষকে ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থেকেও সঞ্চয়ের সুযোগ দিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে মিতব্যয়িতার ধারণা এখন শুধু অর্থ সঞ্চয়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এক নতুন জীবনধারা—“Sustainable Thrift” নামে পরিচিত। এই ধারণার অধীনে মানুষ কেবল অর্থ নয়, সময়, শক্তি, পানি ও খাদ্য অপচয় কমানোর দিকেও মনোযোগী হচ্ছে। জাতিসংঘের Sustainable Development Goals (SDGs)-এর মধ্যে টেকসই ভোগ ও উৎপাদন (Goal 12) এই দর্শনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ইউরোপের ৬২% মানুষ বলেছেন তারা “conscious spending” অভ্যাস গড়ে তুলেছেন—অর্থাৎ প্রয়োজন ছাড়া কিছু কেনেন না।

বিভিন্ন দেশে এই দিবসকে ঘিরে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। জার্মানিতে স্কুল পর্যায়ে ‘Sparen Lernen’ (Learn to Save) কর্মসূচি চালু আছে, যেখানে শিশুদেরকে পিগি ব্যাংক ব্যবহার শেখানো হয়। জাপানে শিশুদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে “Thrift Week” আয়োজন করা হয়, আর সিঙ্গাপুরে সরকার নাগরিকদের ‘Central Provident Fund’ (CPF)-এর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক সঞ্চয় নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সঞ্চয় সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প, ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য সমবায় সঞ্চয় কর্মসূচি, এবং তরুণদের জন্য ডিজিটাল ফাইনান্স লিটারেসি ক্যাম্পেইন চালু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রতিবেদনে বলা হয়—দেশে এখন ৭৯% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনোভাবে আর্থিক সেবার আওতায় এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম অগ্রগতি।

মিতব্যয়িতার দর্শনের সঙ্গে পরিবেশ ও নৈতিকতা গভীরভাবে যুক্ত। ‘Minimalism’ ও ‘Slow Living’ আন্দোলন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে, যার মূলমন্ত্র—কম দিয়ে সুখী থাকা। এর ফলে শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিক শান্তি ও সামাজিক ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে সঞ্চয়ের ধারণা আরও বহুমাত্রিক হয়েছে। ডিজিটাল ওয়ালেট, ক্রিপ্টোকারেন্সি, স্টক বিনিয়োগ, এবং ফিনটেক অ্যাপ—সবকিছুই নতুন প্রজন্মের কাছে মিতব্যয়িতাকে আধুনিক রূপে উপস্থাপন করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় অ্যাপ “Groww” ও “Paytm Money” ব্যবহারকারীদের অল্প টাকায় বিনিয়োগ শেখাচ্ছে, যা সঞ্চয় সংস্কৃতিকে আরও সহজলভ্য করছে।

বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবসের মূল বার্তা তাই শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি দায়িত্ববোধ, সচেতনতা ও টেকসই ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। ব্যক্তি যদি আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখে, তাহলে পরিবারে স্বস্তি আসে, সমাজে স্থিতিশীলতা গড়ে ওঠে, আর রাষ্ট্রের অর্থনীতি হয় শক্তিশালী।

এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—সঞ্চয় মানে শুধু অর্থ জমা নয়, এটি ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, আত্মনির্ভরতার প্রতীক, এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তি। ছোট ছোট সঞ্চয়ের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে বড় অর্জনের ইতিহাস, যেমনটি দেখা গেছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতায়।

মিতব্যয়িতা কেবল অর্থসংক্রান্ত বিষয় নয়; এটি জীবনধারার একটি দিক। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো, শক্তি ও সম্পদ বাঁচানো, এবং টেকসই জীবনযাপন—সবই মিতব্যয়িতার অন্তর্ভুক্ত। এটি মানসিক শান্তি, সামাজিক দায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামের কৃষক, শহরের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা শিক্ষার্থী—সকলেই সচেতন সঞ্চয় ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যতকে আরও নিরাপদ ও স্থিতিশীল করতে পারে।

৩০ অক্টোবরের বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ছোট ছোট সঞ্চয়ই বড় অর্জনের ভিত্তি, সচেতন ব্যয়ই টেকসই জীবনের মূলমন্ত্র, এবং মিতব্যয়িতা মানেই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সমৃদ্ধি। দেশের অর্থনীতি ও নাগরিক জীবনের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য এই শিক্ষাকে প্রতিদিনের জীবনে বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন।

মিতব্যয়িতা হলো জীবনযাপনে সংযম ও পরিকল্পনা বজায় রাখা। অর্থাৎ, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যয় না করা, অর্থ, সময় বা সম্পদ বাঁচিয়ে ব্যবহার করা এবং ভবিষ্যতের জন্য কিছু সংরক্ষণ করা। সহজভাবে বলতে গেলে, মিতব্যয়িতা মানে “যা দরকার, তা খরচ করো; অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়িয়ে যাও”।

এটি শুধু অর্থ সঞ্চয় নয়, বরং জীবনকে সচেতন, দায়িত্বশীল এবং টেকসইভাবে পরিচালনার এক উপায়। মিতব্যয়িতা ব্যক্তিকে ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবিলা, পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা এবং সমাজকে স্থিতিশীলতা দিতে সাহায্য করে।

সহজ উদাহরণ—আপনি যদি আপনার দৈনন্দিন খরচের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে না গিয়ে, সেই টাকা বাঁচিয়ে রাখেন, বা বিদ্যুৎ ও পানি সাশ্রয় করেন, তখন আপনি মিতব্যয়িতার অনুশীলন করছেন।

বাংলাদেশে বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস শুধু একটি আন্তর্জাতিক observance নয়; এটি দেশের আর্থিক সচেতনতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। দেশের অর্থনীতি, জনসংখ্যা এবং সামাজিক কাঠামো বিবেচনা করলে এই দিবসের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চয় ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথাগত পরিবার কাঠামোতে ছোট ছোট সঞ্চয় বা “সংগ্রহ” ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ। যদিও আধুনিককালের ব্যয়সংক্রান্ত অভ্যাস পরিবর্তন করেছে, মিতব্যয়িতা এখনও একটি অপরিহার্য সামাজিক শিক্ষা হিসেবে টিকে আছে।

দেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তি এবং পরিবারের সঞ্চয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের মতে, দেশের মোট জাতীয় সঞ্চয় হার ২৮.৩%, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এই সঞ্চয় হার একটি শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা—সবই ব্যক্তিগত সঞ্চয়কে বৃদ্ধি করছে।

বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস বাংলাদেশের জনগণকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও দায়িত্বশীল ব্যয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি একটি শিক্ষা ক্ষেত্র। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দিবস উপলক্ষে সঞ্চয় সচেতনতা কর্মশালা, আলোচনা সভা এবং তথ্যপ্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শেখে, ছোট ছোট সঞ্চয় কিভাবে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে।

ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারের সঙ্গে এই দিবসের তাৎপর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং এবং ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে মানুষ সহজেই সঞ্চয় শুরু করতে পারছে। উদাহরণস্বরূপ, বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ক্ষুদ্র সঞ্চয় হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

দিবসটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা। মিতব্যয়িতা মানে কেবল অর্থ সঞ্চয় নয়, এটি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো এবং টেকসই জীবনধারা অনুসরণ করার বার্তা বহন করে। বাংলাদেশে এই ধারণা যদি আরও সম্প্রসারিত হয়, তাহলে পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা, গ্রামের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে।

দূরদর্শী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস বাংলাদেশের নাগরিকদের শেখায়—অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, সচেতন ব্যয় এবং সঞ্চয় কেবল ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় উন্নয়নেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মাধ্যমে মানুষ কেবল আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয় না, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবেও গড়ে ওঠে।

বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস (World Thrift Day) এখন একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সচেতনতা দিবসে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। প্রতিটি দেশই তাদের আর্থিক সংস্কৃতি, সামাজিক ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী দিবসটিকে উদযাপন করে—যেখানে মূল উদ্দেশ্য একটাই: জনগণের মধ্যে সঞ্চয়, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও মিতব্যয়িতার চর্চা বিস্তার করা। নিচে বিভিন্ন দেশের পালনের রূপগুলো বিশদভাবে উল্লেখ করা হলো— দিবসটির জন্মভূমি ইতালিতে এখনো এটি বড় পরিসরে পালিত হয়। দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান “Giornata Mondiale del Risparmio” নামে বিশেষ সঞ্চয় সপ্তাহ আয়োজন করে। মিলান, রোম ও ফ্লোরেন্সে বিদ্যালয় পর্যায়ে “Smart Saver” প্রতিযোগিতা হয়, যেখানে শিশুদের মধ্যে ছোট ছোট সঞ্চয়ের গুরুত্ব শেখানো হয়। ইতালির পোস্টাল ব্যাংক (Poste Italiane) গ্রামীণ জনগণকে সঞ্চয়ী হিসাব খোলায় উৎসাহিত করতে এই সময় বিশেষ সুবিধা প্রদান করে।

জার্মানি এই দিবসকে সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পালন করে। প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে পালন করা হয় “Weltspartag” (World Savings Day)। ব্যাংকগুলো স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সচেতনতা বিষয়ক ক্লাস নেয়, ছোট শিশুদের জন্য ‘Sparbuch’ (সঞ্চয় বই) বিতরণ করা হয়, এবং সঞ্চয়কারীদের মধ্যে পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে জার্মান সেভিংস ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন (DSGV) জানায়, তাদের সদস্য ব্যাংকগুলো সেই সপ্তাহে প্রায় ১.২ মিলিয়ন নতুন সঞ্চয় হিসাব খোলে।

জাপানে “Thrift and Savings Week” নামেই দিবসটি পালিত হয়। দেশটির সরকার, ব্যাংক ও স্কুলগুলো যৌথভাবে শিশুদের “ছোট সঞ্চয়, বড় স্বপ্ন” ধারণা শেখায়। জাপান পোস্ট ব্যাংক (Japan Post Bank) স্কুলে গিয়ে শিশুদের পিগি ব্যাংক উপহার দেয়, আর শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় কে এক বছরে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয় করতে পারে। দেশের প্রধানমন্ত্রীও বার্ষিক সঞ্চয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে জনগণকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার বার্তা দেন।

ভারতে দিবসটি “Financial Literacy Week” হিসেবে সরকারি উদ্যোগে পালিত হয়। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (RBI) ও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গ্রাহকদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় স্কিম চালু করে। স্কুল ও কলেজে সঞ্চয় বিষয়ক সেমিনার, সচেতনতা র‍্যালি এবং পোস্টার প্রতিযোগিতা হয়। ২০২৪ সালে ভারতের “Jan Dhan Yojana” কর্মসূচির অধীনে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হয়েছে—যা এই দিবসের মর্মবাণী বাস্তবায়নেরই অংশ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই দিবসের তাৎপর্যকে সংক্ষেপে বলা যায়—এটি ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সুস্থতার প্রতীক, যেখানে ছোট ছোট সঞ্চয় গড়ে তোলে বড় অর্জন, এবং সচেতন ব্যয় ও পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে ওঠে স্থিতিশীল ও টেকসই সমাজ। ব্রাজিল, মেক্সিকো ও চিলিতে দিবসটি সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকগুলো “Thrift for the Family” নামে বিশেষ উদ্যোগ নেয়, যাতে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে সঞ্চয় অভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

সব দেশেই দিবসটির মূল লক্ষ্য এক—মানুষকে শেখানো, অর্থ শুধু খরচের জন্য নয়; এটি ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও মর্যাদার মূলভিত্তি।

আজকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এই দিবসের বার্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ: “সঞ্চয় করো, পরিকল্পনা করো, টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ো।”

কেনিয়া, উগান্ডা ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে এই দিবসকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রসারে ব্যবহার করা হয়। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা যেমন M-Pesa আফ্রিকার গ্রামীণ জনগণের মধ্যে সঞ্চয় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ২০২৪ সালে আফ্রিকায় এই সেবার মাধ্যমে প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা হয়—যা আর্থিক স্বনির্ভরতার এক নতুন দৃষ্টান্ত।

ব্রাজিল, মেক্সিকো ও চিলিতে দিবসটি সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকগুলো “Thrift for the Family” নামে বিশেষ উদ্যোগ নেয়, যাতে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে সঞ্চয় অভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

সব দেশেই দিবসটির মূল লক্ষ্য এক—মানুষকে শেখানো, অর্থ শুধু খরচের জন্য নয়; এটি ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও মর্যাদার মূলভিত্তি।

আজকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে এই দিবসের বার্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ: “সঞ্চয় করো, পরিকল্পনা করো, টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ো।”

কেনিয়া, উগান্ডা ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে এই দিবসকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রসারে ব্যবহার করা হয়। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা যেমন M-Pesa আফ্রিকার গ্রামীণ জনগণের মধ্যে সঞ্চয় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ২০২৪ সালে আফ্রিকায় এই সেবার মাধ্যমে প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা হয়—যা আর্থিক স্বনির্ভরতার এক নতুন দৃষ্টান্ত।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবসকে ক্ষুদ্র সঞ্চয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে পালন করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাংক ইন্দোনেশিয়া “Tabungan Nasional Day” উদযাপন করে, যেখানে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট চালু হয়। ফিলিপাইনে সরকারি ব্যাংকগুলো “Save More, Live Better” শীর্ষক প্রচারণা চালায়।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রে এটি জাতীয় ছুটির দিন নয়, তবে অক্টোবর মাসকে সেখানে “National Financial Planning Month” হিসেবে পালন করা হয়, যা World Thrift Day-এর ভাবনার সঙ্গে একাত্ম। বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ও এনজিও “Money Smart Campaign” আয়োজন করে, যেখানে মানুষকে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরে সরকার নাগরিকদের সঞ্চয়কে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করেছে। তাদের “Central Provident Fund (CPF)” নামে একটি বাধ্যতামূলক সঞ্চয় প্রকল্প রয়েছে, যা নাগরিকদের স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও অবসরকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। World Thrift Day উপলক্ষে CPF বোর্ড বিশেষ সেমিনার আয়োজন করে এবং তরুণদের সঞ্চয়ের মাধ্যমে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের উপায় শেখায়।

বাংলাদেশে ৩০ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয় বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালায়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিশেষ অফার দেয়, এবং ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের জন্য ‘স্মার্ট সেভিংস’ ক্যাম্পেইন চালু করে। স্কুল ও কলেজে “Save Today for Better Tomorrow” শীর্ষক আলোচনা সভা হয়। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদিও এই সময়ে সঞ্চয় সচেতনতা নিয়ে ডিজিটাল প্রচারণা চালায়।
*৩০ অক্টোবর — বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস: নতুন প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের তাৎপর্য*

৩০ অক্টোবর পালিত বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস কেবল সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার জন্য নয়, বরং এটি আর্থিক সচেতনতা, পরিকল্পিত ব্যয় এবং টেকসই জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি এবং তরুণ প্রজন্মের ভোগবাদী মনোভাব বিবেচনা করলে, এই দিবসের তাৎপর্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিতব্যয়িতা দিবস উদযাপনের নতুন নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। নরওয়েতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে “Green Thrift Challenge” আয়োজন করে, যেখানে তারা সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারার ধারণা শেখে। কানাডায় ব্যাংকগুলো “Future Saver Awards” নামে প্রতিযোগিতা আয়োজন করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের সঞ্চয় প্রকল্প উপস্থাপন করে। এ ধরনের উদ্যোগ তরুণদের মধ্যে সঞ্চয় ও আর্থিক পরিকল্পনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশেও নতুন প্রজন্মকে লক্ষ্য করে মিতব্যয়িতা দিবস উপলক্ষে উদ্ভাবনী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে “Digital Savings Hackathon” অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কিভাবে সঞ্চয় বাড়ানো যায় তা নিয়ে প্রকল্প তৈরি করে। দেশের উদ্যোক্তা তরুণরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগ, অ্যাপ ভিত্তিক সঞ্চয় এবং শিক্ষামূলক ফিনটেক অ্যাপ ব্যবহার করে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা গড়ে তুলছে।

দিবসটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য সঞ্চয় শিক্ষা উদ্বুদ্ধ করার নানা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। নারীরা ক্ষুদ্র সঞ্চয়, স্বনির্ভর ব্যবসা এবং যৌথ সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। শিশুদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষামূলক খেলা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের ধারণা অর্জন করছে।

মিতব্যয়িতার মূল ভাবনা কেবল অর্থসংরক্ষণ নয়, এটি জীবনযাত্রার একটি দৃষ্টিভঙ্গি। উদাহরণস্বরূপ, অপ্রয়োজনীয় শক্তি, পানি ও খাদ্য অপচয় কমানো, পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ এবং সময় ও সম্পদ সচেতনভাবে ব্যবহার—all এগুলোই মিতব্যয়িতার আধুনিক রূপ। বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তারা এই ধারণাকে সামাজিক ব্যবসা, ক্ষুদ্র উদ্যোগ এবং পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করছে।

বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস আমাদের শেখায়—*মিতব্যয়িতা কেবল অর্থ সঞ্চয় নয়; এটি জীবন, সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক। ছোট ছোট সঞ্চয় ও পরিকল্পিত ব্যয় ব্যক্তিকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে, পরিবারকে নিরাপদ রাখে, এবং সমাজকে টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যায়।* বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই দিবস দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।