ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ ৩১ অক্টোবর আমরা শুধু একটি বিশেষ দিনে নেই, বরং একটি জীবনদর্শন ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি উদযাপন করবো—বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস ২০২৫। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অতিরিক্ত ভোগবাদ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় যতই আকর্ষণীয় মনে হোক, দীর্ঘমেয়াদে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ব্যয় অপরিহার্য।

মিতব্যয়িতা কেবল অর্থ সঞ্চয় নয়

অনেকে মিতব্যয়িতাকে কৃপণতার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে, মিতব্যয়িতা মানে ‘যথাযথ পরিমাণে ব্যয় করা’। এটি শুধুমাত্র অর্থের ক্ষেত্রে নয়, সময়, শক্তি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানি—প্রতিটি সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার প্রতিফলন। একজন মিতব্যয়ী ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি অংশে সংযমী, যাতে কোনো অপ্রত্যাশিত সংকট তাকে বিপদে ফেলতে না পারে। বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতা, বিশেষ করে ইসলাম, মিতব্যয়িতাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখিয়েছে। কুরআনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, মানুষ যেন অপচয় না করে, মাঝারি ব্যয় করে। অতিরিক্ত ব্যয় বা তুচ্ছতা নয়, বরং সঠিক ভারসাম্যই মিতব্যয়িতার মূল। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি কোনো জিনিস সঠিকভাবে ব্যবহার করে, আল্লাহ তার জন্য বরকত সৃষ্টি করেন।” এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অর্থ, সময় এবং অন্যান্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহার শেখায়।

মিতব্যয়িতা কেন জরুরি

আজকের ভোগবাদী সমাজে আমরা প্রায়শই ভুল বুঝি—ব্যয় বেশি মানে মর্যাদা বেশি। বাস্তবে, অতিরিক্ত ব্যয় কেবল আর্থিক চাপ নয়, এটি পরিবেশ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও ক্ষতিকর।

ব্যক্তিগত আর্থিক নিরাপত্তা: নিয়মিত ও সচেতন ব্যয় ব্যক্তি ও পরিবারের সঞ্চয় নিশ্চিত করে। এটি জরুরি সময় বা বিশেষ প্রয়োজনে সাহায্য করে।

পরিবার ও সামাজিক স্থিতিশীলতা: মিতব্যয়ী পরিবার আর্থিকভাবে স্থিতিশীল থাকে, যা শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করে।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই জীবনযাপন: খাদ্য অপচয় কমানো, বিদ্যুৎ ও পানির সচেতন ব্যবহার, পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার—সবই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।

সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা: সচেতন ব্যয় মানুষের মধ্যে নৈতিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে। অপরিচিতের জন্য সহায়তা, দান ও সমাজসেবা সম্ভব হয়।

ছোট ছোট অভ্যাস যেমন—প্রয়োজনের তুলনায় কম কেনা, বিদ্যুৎ ও পানির অপচয় রোধ, খাদ্য সংরক্ষণ—সবই মিতব্যয়িতার অংশ। এগুলো শুধু অর্থ সাশ্রয় নয়, মানসিক শান্তি ও সামাজিক দায়বদ্ধতাও গড়ে তোলে। এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদে এগুলো ব্যক্তি ও পরিবারের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষা

যদি নতুন প্রজন্মকে ছোটবেলা থেকেই মিতব্যয়িতা ও সঞ্চয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়, তারা বড় হয়ে আরও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।

বিদ্যালয়ের ভূমিকা: পাঠ্যপুস্তকে মিতব্যয়িতা, সঞ্চয় ও টেকসই জীবনধারার গুরুত্ব শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা।

পরিবারের ভূমিকা: অভ্যন্তরীণ অর্থব্যবস্থাপনা, প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয়, বিলাসিতা কমানোর অভ্যাস শিশুদের মধ্যে গড়ে তোলা।

সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা: সচেতন প্রচারণা, টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি।

যেখানে শিশুদের ছোট ছোট দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়, সেখানে তারা বড় হয়ে কেবল সঞ্চয়ীই হবে না, বরং সামাজিক ও পরিবেশ-সচেতন নাগরিক হিসেবেও গড়ে উঠবে।

বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা

আমাদের দেশের অর্থনীতি দ্রুত উন্নয়নের পথে, কিন্তু ভোগবাদও দ্রুত ছড়াচ্ছে। শহরে ব্যয়বহুল জীবনধারা, ব্র্যান্ডের প্রতি আসক্তি—সবই মিতব্যয়িতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ সমস্যা শুধুমাত্র শহরেই নয়, গ্রামের ক্ষেত্রেও নতুন পণ্য ও প্রযুক্তির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রবণতা বেড়ে চলেছে।

তবুও আশার আলো আছে

স্কুল পর্যায়ে প্রচারণা: বিভিন্ন স্কুলে সঞ্চয় সচেতনতা ও মিতব্যয়িতা বিষয়ক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান: সঞ্চয়াভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম।

পরিবেশ-সচেতন উদ্যোগ: প্লাস্টিক কমানো, পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার।

সামাজিক প্রচেষ্টা: স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও কমিউনিটি গ্রুপ সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

এই প্রচেষ্টা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতাও বৃদ্ধি করছে।

মিতব্যয়িতার মানসিক ও সামাজিক দিক

মিতব্যয়িতা কেবল আর্থিক বিষয় নয়। এটি মানসিক শান্তি, আত্মনির্ভরশীলতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতীক।

মানসিক শান্তি: প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেনা ও অপচয় কমানো মানসিক চাপ কমায়।

সামাজিক দায়বদ্ধতা: পরিবারের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করা, কম অপচয় করে সমাজ ও পরিবেশকে রক্ষা করা।

দূরদর্শিতা: ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই জীবনধারা নিশ্চিত করা।

সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন: সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে সৃজনশীল সমাধান ও নতুন ধারণা উদ্ভাবনের প্রেরণা জন্মায়।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ

১. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়: LED বাতি ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় সময় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা।

২. খাদ্য সংরক্ষণ: অপ্রয়োজনীয় খাবার ফেলে না দিয়ে সংরক্ষণ ও পুনঃব্যবহার করা।

৩. পানি সংরক্ষণ: পানির অপচয় রোধ, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ।

৪. পরিবহন: ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে সাইকেল বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার।

৫. পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য: প্লাস্টিক ব্যাগ কমানো, কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার।

৬. ডিজিটাল সচেতনতা: অপ্রয়োজনীয় প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক ব্যবহারে সংযম।

৭. পণ্য পুনঃব্যবহার ও রিসাইক্লিং: পুরনো জিনিস মেরামত করে ব্যবহার করা, বর্জ্য হ্রাস। এই অভ্যাসগুলো ব্যক্তি, পরিবার ও দেশের জন্য আর্থিক, সামাজিক ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

টেকসই সমাজ ও অর্থনীতি

মিতব্যয়িতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতি ও টেকসই সমাজের ভিত্তিও। যারা মিতব্যয়ী, তারা প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্যবহার করে, যা দেশীয় উৎপাদন ও সঞ্চয়কে উৎসাহ দেয়। অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকলে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও সহজ হয়।

দেশে সঞ্চয় ও সচেতন ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি নেওয়া হচ্ছে। ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে বড় কর্পোরেট সংস্থা পর্যন্ত মিতব্যয়ী পরিকল্পনা অনুসরণ করলে রিসোর্সের ব্যবহার কমে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ হয়। এছাড়া, এটি উদ্ভাবনী উদ্যোগকে উৎসাহ দেয়, যেমন পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়ন।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বব্যাপী অনেক দেশই মিতব্যয়িতা ও টেকসই ব্যবহারে নজর দিচ্ছে। ইউরোপ ও জাপানসহ উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তি ও সম্পদের অপচয় কমানো হচ্ছে। এই অভ্যাস বাংলাদেশেও প্রয়োগ করলে জাতীয় অর্থনীতি ও পরিবেশ উভয়ই উপকৃত হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস আমাদের মনে করায়—অপচয় নয়, সচেতনতা; বিলাসিতা নয়, দায়িত্ব; অতিরিক্ত নয়, যথাযথ ব্যয়।

মিতব্যয়িতা কেবল অর্থ সঞ্চয় নয়, এটি এক জীবনদর্শন। আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ববোধ ও দূরদর্শিতা মিলেমিশে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও প্রকৃতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করে।

চলুন, এই বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবসে আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি— “আমি সচেতনভাবে ব্যয় করব, অপচয় নয়; নিজের ও সমাজের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখব।”

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও লেখক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।