বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, মহম্মদপুর : বাংলার আকাশে যখন হালকা বাতাস দোল খায়, তখন গাছের ডালে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসা যেন নিসর্গের বুকে একখানি জীবন্ত শিল্পকর্ম। সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করা সেই বোনা বাসা দেখে মনে হয়, প্রকৃতি যেন নিজ হাতে তাঁত বসিয়ে গেঁথেছে স্বপ্নের নকশা।

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পার্শ্ববর্তী মধুমতি নদীর তীরে তালগাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, প্রকৃতির অদৃশ্য কোনো শিল্পীরা যেন গোপনে এসে এঁকেছে বয়নশিল্পের অমর নিদর্শন।

বাবুই পাখি কেবল এক ক্ষুদ্র প্রাণী নয়-সে প্রকৃতির এক অনন্য স্থপতি। বাংলার মানুষ তাকে চেনে পরম স্নেহে, “শিল্পী পাখি” নামে। ধানক্ষেতের ধারে, গ্রামের প্রান্তে, কিংবা খেজুর ও তালগাছের উঁচু ডালে, সেখানেই সে গড়ে তোলে তার রাজকীয় আশ্রয়।

পুরুষ বাবুই একাই তৈরি করে এই বিস্ময়কর স্থাপনা। খড়, ঘাস, পাটের আঁশ, তালপাতার তন্তু-সবকিছু জুড়ে সে গেঁথে তোলে এক ঝুলন্ত প্রাসাদ। তার বাসায় থাকে একটি লম্বা নলাকার প্রবেশপথ, যেন নিরাপত্তার প্রহরী। স্ত্রী বাবুই এসে যখন সেই বাসা দেখে খুশি হয়, তখনই শুরু হয় তাদের সংসার। আর না পছন্দ হলে পুরুষ বাবুই নতুন করে বুনে ফেলে আরেকটি বাসা, অদম্য অধ্যবসায় ও শ্রমের এক অনন্য উদাহরণ।

বিজ্ঞানীরা বলেন, বাবুই পাখি প্রকৃতির অন্যতম বুদ্ধিমান পাখি। তাদের বাসার কাঠামো শুধু সৌন্দর্যের নয়, প্রকৌশলেরও এক আশ্চর্য উদাহরণ। বৃষ্টির জল, বাতাসের ঝাপটা কিংবা রাতের শিকারির হাত থেকেও সুরক্ষিত থাকে তাদের বাসা।

বাংলা সাহিত্যে বাবুই পাখি এক অবিনশ্বর প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, জীবনানন্দ দাশের কল্পনায়, আর জসীমউদ্দীনের গ্রামীণ কাব্যে বাবুই পাখি এসেছে শ্রম, নৈপুণ্য ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে। সে যেন বলে যায়- “শ্রমই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, ভালোবাসাই শিল্পের জন্ম দেয়।”

আজকের কংক্রিটে মোড়া পৃথিবীতেও বাবুই পাখির বাসা আমাদের শেখায়, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে গেলে সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়।

বাবুই পাখি কেবল ডালে ঝুলে থাকা এক বাসার গল্প নয়-সে এক জীবন্ত দর্শন, যেখানে মিশে আছে শ্রমের মহিমা, প্রকৃতির কবিতা ও জীবনের নান্দনিকতা।

যে পাখি নিজের ভালোবাসা ও শ্রম দিয়ে বুনে ফেলে একখানি স্বপ্নের ঘর, সে কেবল প্রকৃতির সন্তান নয়-সে আমাদের হৃদয়েরও এক নীরব কবি।

(বিএস/এসপি/নভেম্বর ০৪, ২০২৫)