নিউইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র ইসলামভীতি দূর করবেন?
চৌধুরী আবদুল হান্নান
রিপাবলিকান পার্টি শাসিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হলেন ডেমোক্র্যাট পার্টি মনোনিত জোহরান মামদানি। উগান্ডা বংশোদ্ভুত ৩৪ বছর বয়সী এ মুসলিম রাজনীতিক পাহাড় সমান প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অভূতপূর্ব এক বিজয় অর্জন করলেন।
এমন সময় নিয়ইয়র্কে একজন মুসলিম নেতার আবির্ভাব হলো যখন আমেরিকাবাসী নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ৯/১১ এর ভয়াবহ জঙ্গী হামলার স্মৃতি বহন করছে। এই হামলার জন্য ইসলান ধর্মাবলম্বী আল-কায়েদা জঙ্গীদের দায়ী করা হয়।
মেয়র পদপ্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই মামদানিকে মানুষ হিসেবে নয়, একজন মুসলিম হিসেবে নানা সমালোচনার মুখোমুখী হতে হয়েছে এবং নিউইয়র্কে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ নতুন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য অ্যান্ডি ওগলস যিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক বিদ্রুপ করে মামদানিকে “ছোট মোহাম্মদ” বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশ থেকে নির্বাসনের আবেদন করেছেন।
তাঁকে হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল ও জিহাদি সন্ত্রাসী বলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ থেকে জোর প্রচারণা চালানো হয়েছে।
মামদানি ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় গণহত্যার দায়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একজন যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়েছেন। এ কারণে অনেকে বলেছেন, মামদানি হিন্দুত্ববিরোধী ও ভারত বিরোধী।
মামদানিকে এভাবে আক্রমণের মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তবে নিজের মুসলিম পরিচয়কে যে সাহসের সাথে গ্রহণ করেছেন মামদানি, সেটাই তাকে আজ এগিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প শাসনামলে অভিবাসী ও মুসলিম বিদ্বেষের আশঙ্কা যেভাবে বাড়ছে, মামদানির সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়া তার উপযুক্ত জবাব বলা যায়। তিনি আরও বলেন, আমি একজন প্রগতশীল মুসলিম অভিবাসী, আমি আমার সত্যিকার বিশ্বাস থেকে লড়ি।
২০০২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মানের বিরুদ্ধে টাইমস স্কয়ারে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন মামদানি। এ কারণে তার প্রতি মোদির সমর্থকদের সমালোচনা ও ক্ষোভ রয়েছে।
উদীয়মান এই রাজনৈতিক তারকার চারদিকে ইসরায়েল লবি, বৈশ্বিক হিন্দুত্ববাদী ও শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা মিলে একটি শক্ত দেয়াল তুলে দিয়েছিল। মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী স্রোতেও দিকভ্রান্ত হননি। নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনোভাবেই চাননি মামদানির মতো একজন মুসলিম অভিবাসী এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন।
ঠাট্টা-মশকরা করে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এই শহরে তিনি হালাল খাবার বাধ্যতামূলক করবেন কিনা।বিদ্রুপ করে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হতো, নির্বাচনে জিততে চাইলে যেন তিনি মানুষকে বলতে না যান যে তিনি মুসলমান, তিনি ফিলিস্তিনপন্থী।
নিউইয়র্ক শহরে ১০ লক্ষাধিক মুসলিম এমন ভাবে বসবাস করতে হচ্ছে যেন তারা নিজ বাড়িতেই অতিথি। সরকার ও তাদের প্রভাবশালী গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে এ কথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে-ইসলাম হলো সহিংসতা এবং সন্ত্রাস লালনকারী একটি ধর্ম। মুসলমান মানেই অসহিষ্ণু, জঙ্গী-সন্ত্রাসী।
৯/১১ এর ছায়ায় সন্দেহের এক গভীর স্রোতে বেড়ে উঠা মামদানি অনুধাবন করেছেন বেঁচে থাকার অর্থ।
নির্বাচনী প্রচারণায়, বক্তৃতায় তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ও চৌকস উপস্থাপনা ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে। তিনি মনে করেন এত বড় অসম্মানের মুখে সহনশীলতাই একমাত্র পথ। মানবাধীকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বরাবরই মুখ খুলেছেন তিনি। মামদানি বলেন, আমি শুধু মুসলমান ভোটারদের জন্য প্রাথী হইনি, বরং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক নিউইয়র্কবাসীর জন্য লড়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাঁর দেশের সরকারের অর্থাৎ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কড়া সমালোচক হিসেবেও মামদানিকে চেনা যায়, বিশেষত ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে।
তিনি শ্রমিক শ্রেনির অধিকার এবং জীবনযাত্রার খরচ কমানোর জন্য লড়াই করছেন। তৃণমূল পর্যায়ের বড় সমর্থন এবং সাহসী বামপন্থী ধারার মধ্য দিয়ে জোহরান মামদানির এই সাফল্য এসেছে। তিনি বলেছিলেন আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবো না, এখন নিজেদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁর সাহসিকতার জন্যও তিনি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন।নিউইয়র্ক সিটির অনেক ইহুদি তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন এই কারণে যে, ইহুদি নেতা নেতানিয়াহু একজন ঠান্ডা মাথার মানুষ হাত্যাকারী হিসেবে চিহ্নত।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে আমার জেতার পর যদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে আসেন, তাহলে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেবেন।
যদিও এটা রাজনৈতিক বক্তব্য তবুও তা মূল্যহীন নয়, বিশ্ব বিবেকের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য কোটি কোটি মানুষ তার প্রতি সাহানুভূতিশীল হবেন।
ইসরাইল কর্তৃক গাজায় নির্বিচারে মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে তাঁর সাহসী অবস্থানের কারণে মুসলিম ভোটার একচেটিয়া তাঁর পক্ষে এসেছে, তা বলা যায়। তিনি এখন নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র, সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় এখন তাঁর।
একজন বহিরাগত মুসলিম অভিবাসী বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কের মতো একটি বহুজাতিক ও বহুভাষিক বিশ্বখ্যাত মহানগরীর শীর্ষপদে আসীন হওয়া কেবল অভূতপূর্বই নয়, বিস্ময়করও। তিনি মার্কিন রাজনীতি ও সামজিকভাবে মুসলমানদের একটা স্বস্তি ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাবেন বলে অনেকেরই বিশ্বাস। এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, শুধু রাজনৈতিক বিজয় নয়, মুসলমানদের প্রতি এখানকার সমাজের আস্থার পুনর্নির্মাণের ভিস্তি প্রস্তরও রচিত হবে। ৯/১১ এর পর মুসলিম পরিচয়টাই হয়ে উঠেছিল একটি উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। সেই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সন্দেহের দেয়াল ভেঙে সামনে এগিয়ে এসেছেন আমেরিকার মুসলিম সমাজ। নতুন মেয়র মুসলমান, এখন তিনি প্রমান করবেন, ইসলাম জঙ্গীবাদে বিশ্বাসে ধর্ম নয়, বরং একটি মানবতাবাদী ধর্ম।
একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের রক্ষণশীল অসহিষ্ণু আচারণ ও জঙ্গী তৎপরতার কারণে পবিত্র ধর্ম ইসলামের গায়ে জঙ্গীবাদের তকমা লাগানোর প্রবণতা বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যণীয়।
২০১৫ সালের জুনে পাকিস্তানের নারী শিক্ষাকর্মী মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর তালেবান মুসলিম জঙ্গীদের হত্যা চেষ্টা এবং ২০২২ এর সেপ্টেম্বরে ইরানে “সঠিকভাবে” হিজাব না পরায় দেশটির নীতি পুলিশের হাতে ২২ বছরের তরুণী মাহশা আমিনীর আহত হওয়া এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে মৃত্যুর ঘটনা সারা দুনিয়া তোলপাড় হয়েছিল।
ইসলাম প্রকৃতপক্ষে নারীকে গৃহবন্দী করা বা নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে নয়, যারা এ কাজে অতিউৎসাহী তাদের ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞতা রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি দূর করতে মুসলমান প্রধান দেশগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বে ৮ম জনসংখ্যার দেশ যেখানে ৯০ শতাংশ মুসলিম নাগরিকের বসবাস। যারা ওয়াজ মাহফিলে ধর্মের বাণী প্রচার করেন তাদের অনেকেরই ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে।
অনেক সময় তারা ইসলামের নানা বিষয়ে অপব্যাখ্যা, মনগড়া কথাবার্তা, অবাস্তব ঘটনাবলীর বর্ণনা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলেন। সেখানে ধর্মকে মানব কল্যানের দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা না করে অন্ধ অলৌকিকতা বেশি প্রকাশ করা হয়।
ইসলাম ধর্মের মহানবী (স) এর উদারতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বহু নজির রয়েছে।
শুধু কথায় নয়, কর্মের মাধ্যমে ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে হবে। নিউইয়র্কে একজন মামদানি আছেন, তরুণ প্রগতিশীল নেতা উল্কার গতিতে যার উথ্থান, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ধর্মের মূলবাণী দেশে দেশে নিজ নিজ কর্মগুণে প্রচার করতে হবে। এভাবে নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান ইসলামভীতি দূর হতে থাকবে, এমন বিশ্বাস আমাদের।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।
