টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে সমন্বিত নীতি, দক্ষতা ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজন
ওয়াজেদুর রহমান কনক
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ডেটা ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই তিনটি বিষয় পরস্পর-সম্পর্কিত এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করে, যার ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামো এখন বহুস্তরীয়। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত সব পর্যায়ে নীতি বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবল সংকট, সমন্বয়ের অভাব এবং প্রশাসনিক জটিলতা বিদ্যমান। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ফলে অনেক সময় নীতি গ্রহণের পরও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। যেমন, একই লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা সংস্থা কাজ করলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগের অভাব ও তথ্য আদান-প্রদানের সীমাবদ্ধতা প্রকল্পের ফলাফলকে দুর্বল করে দেয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি সক্ষম, জবাবদিহিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনিক কাঠামো—যেখানে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় অগ্রাধিকার পায়।
এরপর আসে ডেটা ঘাটতির সমস্যা। এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্যের অগ্রগতি মাপতে নির্ভরযোগ্য, হালনাগাদ এবং সময়োপযোগী ডেটা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেক সূচকের তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ বা অসঙ্গতিপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের উপযুক্ত প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ না থাকায় পরিসংখ্যানগত তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফলে নীতি-নির্ধারণে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। ডেটা ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয়করণ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্য সংরক্ষণ ও শেয়ারিং, এবং গবেষণা-ভিত্তিক তথ্য যাচাই পদ্ধতির বিকাশ এ সমস্যার মূল সমাধান হতে পারে।
রাজনৈতিক অস্থিরতাও এসডিজি বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায়। টেকসই উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ছাড়া সম্ভব নয়। ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন, প্রশাসনিক অদলবদল, এবং বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়ন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায়। উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারায়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্ষুণ্ন হয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততাও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই একটি স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা অপরিহার্য, যেখানে উন্নয়ন লক্ষ্য দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার হিসেবে গৃহীত হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা জরুরি। প্রথমত, নীতিগতভাবে “Whole-of-Government Approach” অনুসরণ করা উচিত, যেখানে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যৌথভাবে এসডিজি বাস্তবায়নে কাজ করবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে—যাতে নীতিনির্ধারণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ তথ্যভিত্তিক হয়। তৃতীয়ত, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় এসডিজি ধারণা সংযোজন করে তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে হবে, কারণ তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সম্ভব নয়। চতুর্থত, স্থানীয় সরকারকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় অধিকতর ক্ষমতা ও বাজেট দিতে হবে, যাতে স্থানভিত্তিক বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান স্থানীয় পর্যায়ে নেওয়া যায়।
নীতিগত সুপারিশ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন কাঠামোকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে—যেখানে তথ্য-প্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ, এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকবে মূল ভিত্তি হিসেবে। সরকার, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিটি লক্ষ্য অর্জনের পথে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারলে এসডিজি বাস্তবায়ন শুধু একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন অভিযাত্রায় রূপ নেবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (Sustainable Development Goals—SDGs) হলো ২০১৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এক বৈশ্বিক অঙ্গীকার, যার মূল উদ্দেশ্য মানবজীবনের মানোন্নয়ন, দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং একটি ন্যায়সংগত ও শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। মোট ১৭টি লক্ষ্য ও ১৬৯টি উপ-লক্ষ্য নিয়ে গঠিত এই কাঠামোটি ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশকে তাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের জন্য এই লক্ষ্যগুলো কেবল একটি আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং এটি স্বাধীনতার আদর্শ, উন্নয়ন নীতি এবং সামাজিক অগ্রযাত্রার ধারাবাহিক অংশ। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্বাস্থ্যখাতে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে।
তবে টেকসই উন্নয়ন একটি জটিল ও বহু-মাত্রিক প্রক্রিয়া। এটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবেশের ভারসাম্য ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার সমন্বিত রূপ। এই কারণে এসডিজি বাস্তবায়নের পথে নানা চ্যালেঞ্জ সামনে আসে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা সীমিত, তথ্যের ঘাটতি প্রকট, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রায়ই অনিশ্চিত থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
দেশটি উন্নয়ন যাত্রায় ইতিমধ্যেই অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে—দারিদ্র্যের হার কমেছে, সাক্ষরতার হার বেড়েছে, এবং নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এসডিজির সবগুলো লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই অগ্রগতিকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশাসনিক কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, নির্ভরযোগ্য ডেটা সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা, এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রায়ই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতি কাঠামো, যেখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, প্রমাণভিত্তিক পরিকল্পনা, এবং অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করা হবে। এসডিজির বাস্তবায়ন কেবল সরকারের কাজ নয়—এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব, যেখানে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, গবেষক ও উদ্যোক্তাদেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
অতএব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ডেটা ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা—এই তিনটি মূল প্রতিবন্ধকতার কারণ, প্রভাব ও সমাধানমূলক কৌশল বিশদভাবে অনুধাবন করাই হবে টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের সফলতা নির্ধারণের প্রধান চাবিকাঠি।
শুরুতেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ধারণা তুলে ধরা হয়। এতে প্রথমেই ব্যাখ্যা করা হয়, কীভাবে জাতিসংঘের ঘোষিত এই লক্ষ্যসমূহ মানবসমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির রূপরেখা নির্ধারণ করেছে এবং কেন বাংলাদেশ তার অংশীদার হিসেবে একটি বিশেষ দায়িত্ব বহন করছে। ভূমিকা অংশে এসডিজির মূল উদ্দেশ্য—দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য দূরীকরণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়। পাশাপাশি, স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দেখানো হয় যে, পূর্ববর্তী সাফল্যগুলো এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য কেমন একটি ভিত্তি তৈরি করেছে।
এরপর আলোচনায় আসে টেকসই উন্নয়নের জটিলতা ও বহুমাত্রিক চরিত্র। এখানে দেখানো হয়, টেকসই উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয় নয়—এটি সামাজিক সমতা, পরিবেশ রক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার এক সমন্বিত প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের পথে কীভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তা বিশ্লেষণ করা হয়।
বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করা হয়, যেখানে প্রশাসনিক অদক্ষতা, জবাবদিহিতার অভাব, সমন্বয়হীনতা এবং নীতির অস্থিরতা কীভাবে উন্নয়ন কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে তা বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর ডেটা ঘাটতির সমস্যা তুলে ধরা হয়—বিশেষত পরিসংখ্যানগত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা, তথ্য সংগ্রহের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং প্রমাণভিত্তিক নীতি গ্রহণে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, তা এখানে স্পষ্ট করা হয়। তারপর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব ব্যাখ্যা করা হয়—যেখানে নীতির ধারাবাহিকতা ভেঙে যাওয়া, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ব্যর্থতার দিকগুলো আলোচিত হয়।
এখানে বলা হয়, কীভাবে সরকার, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা একত্রে কাজ করে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন, ডেটা ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, এবং স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন—এসব বিষয় সমাধান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। পাশাপাশি “Whole-of-Government Approach” বা সার্বিক সরকারি অংশগ্রহণের কৌশল তুলে ধরা হয়, যাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এক সুসমন্বিত ধারায় পরিচালিত হয়।
এসডিজি বাস্তবায়ন কেবল একটি প্রশাসনিক কাজ নয়, বরং এটি একটি জাতীয় অঙ্গীকার ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন অভিযাত্রা। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা, এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক অগ্রণী উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য কেবল একটি বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং এটি দেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নযাত্রার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা। এই লক্ষ্যসমূহ অর্জনের মাধ্যমে কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই নয়, বরং সামাজিক ন্যায়, মানবিক মর্যাদা, পরিবেশের ভারসাম্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার এক সমন্বিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশের উন্নয়নচিত্রে গত এক দশকের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক হলেও তা এখন এক গভীর রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই রূপান্তর টেকসই হবে কি না—তা নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এখনো প্রশাসনিক কাঠামোর মূল সীমাবদ্ধতা হিসেবে রয়ে গেছে। দক্ষ জনবল তৈরি, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়, নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও দায়িত্ববোধের অভ্যন্তরীণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একমাত্র পথ। একইভাবে, নির্ভরযোগ্য ও হালনাগাদ ডেটা ছাড়া উন্নয়ন অগ্রগতি নির্ণয় করা কঠিন। তাই ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ নিয়োগ এবং গবেষণাভিত্তিক প্রমাণনির্ভর নীতি প্রণয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখানে একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হলে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় নীতির স্থায়িত্ব ও নিরপেক্ষতা রক্ষা করা জরুরি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে উন্নয়ন উদ্যোগগুলো বাস্তব রূপ নিতে পারবে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করলে টেকসই উন্নয়নের প্রক্রিয়াটি জনমুখী হয়ে উঠবে।
এসডিজি বাস্তবায়ন কোনো একক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়—এটি এক সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ, যা সমাজের প্রতিটি শ্রেণির অংশগ্রহণ ছাড়া অসম্পূর্ণ। এই লক্ষ্যে নীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, গবেষণা ও নেতৃত্ব—সব কিছুর মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সেতুবন্ধন প্রয়োজন। বাংলাদেশ যদি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার করে, তথ্যব্যবস্থাকে আধুনিক করে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন শুধু সম্ভবই নয়, বরং তা দেশের উন্নয়ন ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করবে—যেখানে উন্নয়ন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী।
লেখাটির তথ্যভিত্তি মূলত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (Sustainable Development Goals—SDGs) সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দলিল, সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন নথি, এবং বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন প্রতিবেদনের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত “Transforming Our World: The 2030 Agenda for Sustainable Development” নথিটি এই আলোচনার প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই বৈশ্বিক নীতিমালা বিশ্বের সকল দেশের জন্য একটি অভিন্ন রূপরেখা তৈরি করেছে, যেখানে ১৭টি মূল লক্ষ্য ও ১৬৯টি উপ-লক্ষ্যের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, জলবায়ু সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, ও ন্যায়বিচারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখাটিতে ব্যবহৃত তথ্যের বড় একটি অংশ এসেছে সরকার কর্তৃক প্রণীত “SDG Progress Report,” “Seventh Five Year Plan (2016–2020),” এবং “Perspective Plan of Bangladesh 2021–2041” থেকে। এসব নথিতে সরকারের অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে বিশদ পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS), পরিকল্পনা কমিশন, এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (GED) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এসব সরকারি উৎসে দারিদ্র্যের হার, শিক্ষায় অগ্রগতি, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন, নারী অংশগ্রহণ এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, যা লেখার বিশ্লেষণকে বাস্তবতার ভিত্তিতে স্থাপন করেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)-এর বিভিন্ন প্রকাশনা থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, এবং ডেটা সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা নিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পাওয়া যায়। বিশেষত, UNDP ও UNESCAP কর্তৃক প্রকাশিত “Asia-Pacific SDG Progress Report” বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অবস্থান তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করেছে, যা এই আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক।
লেখায় আলোচিত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা সংক্রান্ত তথ্য মূলত বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ, গণমাধ্যম বিশ্লেষণ, এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD)-এর গবেষণাপত্র থেকে সংগৃহীত। এসব উৎসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিগত ধারাবাহিকতা কীভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, তার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
এই লেখার তথ্যের উৎসগুলো আন্তর্জাতিক নীতিপত্র, জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, সরকারি পরিসংখ্যান, এবং গবেষণা-প্রতিবেদনের সমন্বয়ে গঠিত, যার ফলে এতে উপস্থাপিত বিশ্লেষণ তাত্ত্বিক নয় বরং বাস্তবভিত্তিক ও নীতিনির্ভর হয়েছে। এই সংমিশ্রিত তথ্যভিত্তিই বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও সমাধানমূলক কৌশল নির্ধারণে লেখাটিকে একটি যৌক্তিক ও প্রমাণনির্ভর কাঠামো দিয়েছে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
