গ্রামবাংলার স্বাদ ও স্মৃতি মিশে থাকা বুনো আমড়া, নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ ঐতিহ্য
বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, মহম্মদপুর : গ্রামবাংলার মাটির গন্ধে ভেজা সকালবেলা, কুয়াশা সরতে না সরতেই মাঠের আলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যে দৃশ্য চোখে পড়তো-তার মধ্যে বুনো আমড়া ছিল এক অনন্য নাম।মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গাছের ডালে থোকা থোকা ঝুলে থাকা ছোট সবুজ গোল ফলগুলো দেখতে যেমন মনোরম, স্বাদে ছিল তেমনি আলাদা।
টক-মিষ্টির মিশেল, খেতে লবণ-মরিচ বা কাঁচা মরিচ-লবণ-তেলে মাখিয়ে খেলে যে তৃপ্তি মিলতো— সে স্বাদ আজও অনেকের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই পরিচিত বুনো আমড়া এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।
গ্রামাঞ্চলে মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে বুনো আমড়া গাছ।
এক সময়, বাড়ির আঙিনা, পুকুরপাড়, জঙ্গল কিংবা বাঁশ ঝাড়ের পাশে স্বাভাবিক ভাবেই আমড়ার গাছ জন্মাতো। কোনো বিশেষ যত্ন নিতো না কেউ-প্রকৃতি স্বয়ং লালন করত তাকে। এখন সেই দৃশ্য হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে।
বিশেষজ্ঞ ও প্রকৃতি গবেষকদের মতে, নানা কারণে বুনো আমড়ার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে- জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর গৃহস্থালি বিস্তারের ফলে গ্রামীণ প্রকৃতির নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশ কমে যাচ্ছে। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, ফলে স্বাভাবিক উদ্ভিদ জন্মানোর ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আগে যে বুনো ফল গাছগুলোকে মানুষ প্রকৃতির অংশ হিসেবে রেখে দিত, এখন সেই জায়গাগুলো ব্যস্ত সবজী ও বাণিজ্যিক ফল চাষের অধীন।
বীজ ছড়ানোর সুযোগ কমে গেছে, বুনো প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় বীজ ছড়িয়ে পড়ার পথও সংকুচিত।
গ্রামের প্রবীণদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে- সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে আমড়ার ডালে লাঠি ছুঁড়ে দুই-চারটা পাড়া ছিলো নিয়মের মতো।
তারপর লবণ-মরিচ মেখে আঙিনায় বসেই খাওয়া-সে আনন্দ আলাদা।
বুনো আমড়ার স্বাদ ছিল গভীর-ঝাঁঝালো টক,যার মধ্যে থাকে প্রকৃতির কাঁচা ঘ্রাণ। বর্তমান বাজারে পাওয়া চাষ করা আমড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় আকৃতির, সুন্দর দেখতে, কিন্তু সেই অতীত দিনের শৈশবের টক-মিষ্টি গন্ধ নেই তাতে।
শুধু স্বাদেই নয়, বুনো আমড়া ছিল ভেষজ গুণে অনন্য। গলা ব্যথা ও সর্দি-কাশিতে, রুচি বাড়াতে পেটের পীড়ায়, ক্ষত সারাতে গ্রাম্য হাকিম ও ভেষজ চিকিৎসকেরা আমড়ার শিকড়, পাতা ও ফল ব্যবহার করতেন নানা ওষুধ প্রস্তুতিতে।
বুনো আমড়া আবার ফিরে আসতে পারে আমাদের গ্রামে, যদি আমরা চাই। স্থানীয় নার্সারি গুলো বুনো আমড়ার বীজ সংগ্রহ ও চারা উৎপাদন করতে পারে।
স্কুল ও গ্রাম পর্যায়ের সচেতনতামূলক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে আমড়াকে যুক্ত করা যেতে পারে। রাসায়নিক চাষ কমিয়ে জৈব ও প্রকৃতি-বান্ধব কৃষি ব্যবস্থায় ফিরতে হবে।
প্রকৃতির যে সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য আমরা হারাচ্ছি, তা ফিরিয়ে আনতে চাইলে সম্মিলিত উদ্যোগই হতে পারে একমাত্র পথ। বুনো আমড়া শুধু একটি ফল নয়-এটি গ্রামবাংলার হৃদয়ের স্মৃতি,শৈশবের রসনা,প্রকৃতির মৌলিক সৌন্দর্যের প্রতীক।
আজ যদি আমরা এটিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু গল্পেই শুনবে।
(বিএসআর/এএস/নভেম্বর ০৭, ২০২৫)
