মো. ইমদাদুল হক সোহাগ


বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির চিরন্তন মন্ত্র— “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়” —আজ নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য দ্রুত বদলাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন দক্ষিণ এশিয়াকে তাদের পরবর্তী কৌশলগত কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করছে। এই পরিবর্তনের মাঝেই বাংলাদেশ তার পুরোনো নীতিকে নতুন অর্থে সংজ্ঞায়িত করেছে— সক্রিয় নিরপেক্ষতা।

এই নিরপেক্ষতা কেবল সংঘাত এড়ানোর কূটনীতি নয়; বরং সচেতনভাবে প্রতিটি শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বার্থের মিলনবিন্দু। বিশ্বশক্তিগুলোর কাছে এটি এখন আর একটি ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল রাষ্ট্র নয়, বরং ইন্দো-প্যাসিফিক ভারসাম্যের কেন্দ্রীয় নোঙর।

কিন্তু কূটনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি এই অবস্থানের একটি অদৃশ্য খরচও রয়েছে। যে নীতি আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কে স্বাধীনতা এনে দেয়, সেটিই কখনো কখনো অর্থনৈতিক ভারসাম্যে চাপ সৃষ্টি করে।
তাই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ— সক্রিয় নিরপেক্ষতার এই মূল্য কত এবং তা কি আমাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে শক্ত করছে, নাকি ক্রমে ভঙ্গুর করছে?

ভারসাম্যের বাস্তবতা: সুযোগ ও ঝুঁকির যুগল মুখ

বাংলাদেশ এখন এক সূক্ষ্ম সমীকরণের ভেতরে আছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, অন্যদিকে চীনের বৃহৎ অবকাঠামো বিনিয়োগ — এই দ্বিমুখী ভারসাম্য বজায় রাখা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল চ্যালেঞ্জ। তবে ভারসাম্য তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা অর্থনীতিকে বৈদেশিক চাপমুক্ত রাখে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ঋণ পরিশোধে প্রায় তিন দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের চাপ ফেলেছে। একই সঙ্গে ডলারের অস্থিরতা ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে।

ঋণের জটিলতা: বড় প্রকল্পগুলোতে বিদেশি অর্থায়ন অপরিহার্য হলেও, ঋণনির্ভর উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ। রিজার্ভ ক্ষয়, আমদানি ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ একত্রে অর্থনীতিকে দুর্বল করছে।
একটি সুস্থ অর্থনীতি কখনোই দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভর করে টেকসই হতে পারে না।

বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা: ২০২৫ সালের মে মাসে প্রতিবেশী দেশের দ্বারা বাংলাদেশি পণ্যের আমদানি সীমিতকরণ দেখিয়ে দিয়েছে — রাজনৈতিক বন্ধুত্ব সবসময় অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব দেয় না। আঞ্চলিক সহযোগিতার কথার আড়ালেও প্রায়ই বাণিজ্যিক স্বার্থই মুখ্য ভূমিকা রাখে। ফলে বাংলাদেশকে এখন তার বাজারভিত্তিক কূটনীতিকে আরও সক্রিয় করতে হবে।

নৈতিক নেতৃত্ব বনাম বিনিয়োগ বাস্তবতা

‘ঢাকা নীতিমালা’ বাংলাদেশের নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। রোহিঙ্গা ইস্যু, জলবায়ু ন্যায়বিচার, মানবিক কূটনীতি — এসব ক্ষেত্রে আমাদের নীতি প্রশংসিত হয়েছে। তবে বৈশ্বিক রাজনীতি কেবল নৈতিকতা দিয়ে চলে না; চলতে হয় অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে।

২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কূটনৈতিক ভারসাম্যে নতুন গতি এসেছে, কিন্তু অর্থনীতি এখনো কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে, তবে এটি স্থায়ী সমাধান নয়। অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠন না হলে, নৈতিক শক্তি একসময় অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতায় বন্দী হয়ে পড়বে। বাংলাদেশকে এখন ‘নৈতিক নেতৃত্বের’ চেয়ে ‘বিনিয়োগযোগ্য নেতৃত্ব’ হতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশে স্থিতিশীলতা, নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা ও শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা — এই তিনটি দিকই ভবিষ্যৎ সার্বভৌমত্বের ভিত্তি।

বিমস্টেক ও আঞ্চলিক সম্ভাবনা

বঙ্গোপসাগরীয় বহুখাত সহযোগিতা জোট বা বিমস্টেক এখন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক সুযোগের জানালা খুলেছে। এই ফোরামে বাংলাদেশের নেতৃত্ব কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। নীল অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য শক্তি ও ডিজিটাল সংযোগে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে বিমস্টেককে কার্যকর অর্থনৈতিক কাঠামোয় রূপান্তর করতে হবে। যদি এই মঞ্চটি কেবল নিরাপত্তা ও আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এর সুফল আসবে না। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে একটি আঞ্চলিক বিনিয়োগ করিডর, যেখানে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সহজ হবে এবং বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। এইভাবে সক্রিয় নিরপেক্ষতাকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে বাংলাদেশ নতুন এক ভূরাজনৈতিক মানচিত্রের কেন্দ্রে অবস্থান নিতে পারবে।

অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব: নিরপেক্ষতার প্রকৃত পরিমাপক

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কেবল ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব মানে এমন এক নীতি, যেখানে বৈদেশিক সিদ্ধান্ত অভ্যন্তরীণ স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, বাইরের প্রভাব দ্বারা নয়। এই অবস্থান নিশ্চিত করতে হলে আমাদের তিনটি মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য— প্রথমত, ঋণ কাঠামো পুনর্বিন্যাস। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ হ্রাস করতে হবে এবং নতুন ঋণ গ্রহণে স্বচ্ছতা আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্য। একই অঞ্চলের ওপর নির্ভরতা না রেখে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ শিল্প উন্নয়ন। স্থানীয় উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পকে প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে আমদানিনির্ভরতা কমে আসে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। এই সংস্কারগুলো কার্যকর হলে সক্রিয় নিরপেক্ষতা আর কূটনৈতিক শব্দ থাকবে না, এটি হবে অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক।

নিরপেক্ষতা নয়, সক্ষমতার প্রতিযোগিতা

বাংলাদেশ এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক না হলে নিরপেক্ষতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। কূটনীতির সাফল্য তখনই অর্থবহ, যখন তা ঘরে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ায়। সক্রিয় নিরপেক্ষতা তখনই সফল হবে, যখন দেশীয় অর্থনীতির শক্তিকে অগ্রাধিকার দেবে, নৈতিক কূটনীতিকে বিনিয়োগ কূটনীতিতে রূপান্তর করবে এবং প্রতিটি আন্তর্জাতিক সমঝোতা জাতীয় শিল্প ও কর্মসংস্থানের পক্ষে ফলপ্রসূ হবে। বাংলাদেশ এখন “প্রাচীর নয়, সেতু গড়ার” যে স্বপ্ন দেখছে, সেই সেতুর ভিত্তি হতে হবে দৃঢ় অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা ও স্বাবলম্বিতা। সক্রিয় নিরপেক্ষতা কেবল রাজনৈতিক অবস্থান নয়— এটি এখন অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। এটাই সময়ের দাবি, এটাই রাষ্ট্রীয় দূরদর্শিতার চূড়ান্ত পরীক্ষা।

লেখক : ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক এবং উদ্যোক্তা।