ওয়াজেদুর রহমান কনক


মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় বিজ্ঞান কেবল জ্ঞানের উৎস নয়, এটি শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়নের এক শক্তিশালী ভিত্তি। যখন সমাজ বৈজ্ঞানিক চিন্তা, যুক্তি ও অনুসন্ধানচেতনায় পরিচালিত হয়, তখন অন্ধবিশ্বাস, বৈষম্য ও সংঘাতের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসে। বিজ্ঞান মানুষের মননকে মুক্ত করে, ন্যায়ের বোধ জাগ্রত করে এবং সমাজকে যুক্তিনিষ্ঠ ও সহনশীল করে তোলে। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, কৃষি, জ্বালানি কিংবা পরিবেশ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি মানুষের জীবনে আশার আলো জ্বালায়। তাই মানবতার কল্যাণে বিজ্ঞানের ব্যবহার আজ শুধু একাডেমিক প্রয়োজন নয়, এটি বিশ্বশান্তি ও টেকসই উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত। বিজ্ঞানকে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত করাই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃত চ্যালেঞ্জ ও সাফল্যের মানদণ্ড।

বিশ্ব বিজ্ঞান দিবস ফর পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এখন এক আন্তর্জাতিক ঐক্যের প্রতীক। প্রতি বছর ১০ নভেম্বর দিবসটি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে পালিত হয়, কিন্তু লক্ষ্য একটিই— বিজ্ঞানকে শান্তি, উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করা। দেশভেদে পালনের ধরন ভিন্ন হলেও এর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে গবেষণা, শিক্ষাবিস্তারে বিজ্ঞানমনস্কতা, এবং জনগণের অংশগ্রহণ।

বিজ্ঞান আজ কেবল ল্যাবরেটরির সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত এক শক্তি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ যখন আগুন আবিষ্কার করেছিল, তখন থেকেই মানবসভ্যতা বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে চাকা, কৃষি, ধাতু, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যার মতো জ্ঞানক্ষেত্র বিস্তৃত হতে থাকে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথেই মানুষ উপলব্ধি করে— প্রকৃতি ও সমাজের নিয়মকে বুঝে তবেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি অভাবনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার আমাদের যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা ও বিনোদনের চিত্রই পাল্টে দিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল কয়েক কোটি, আজ তা ৫০০ কোটিরও বেশি। এই ডিজিটাল সংযোগ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এক সুতায় গেঁথে দিয়েছে, যেখানে জ্ঞান ও তথ্যই সবচেয়ে বড় সম্পদ। একইভাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন শিল্প, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও প্রশাসনে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো পর্যন্ত স্মার্ট গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠায় এআই-নির্ভর ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগতি মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। জিন থেরাপি, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্গান প্রিন্টিং, ও ন্যানোমেডিসিন ইতোমধ্যে বহু জটিল রোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছে— বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা অসম্ভব। ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও বিতরণের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক নেটওয়ার্ক যেভাবে কাজ করেছে, তা বিজ্ঞান ও মানবতার ঐক্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলেও, বিজ্ঞানই সেখানে আশা জাগাচ্ছে। জেনেটিকালি মডিফায়েড ফসল, ড্রোন-ভিত্তিক মনিটরিং, ও স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা কৃষিকে করছে অধিক কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে খাদ্য ঘাটতি অনেকাংশে কমেছে। একইসঙ্গে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার— যেমন সৌর, বায়ু ও বায়োগ্যাস— গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি এনেছে।

বিজ্ঞান শুধু উন্নয়নের বাহন নয়, এটি শান্তির রক্ষাকবচও বটে। পারমাণবিক শক্তির উদ্ভাবন যেমন মানবজাতির জন্য ভয়াবহ সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি তা শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন ও চিকিৎসায় যুগান্তকারী সুফল দিয়েছে। জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার মাধ্যম হিসেবে দেখছে। বিশ্বজুড়ে পরিচালিত নানা গবেষণা সহযোগিতা কর্মসূচি— যেমন CERN, WHO, Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC), ও International Space Station— প্রমাণ করে, বিজ্ঞান কোনো জাতির একক সম্পত্তি নয়; এটি মানবজাতির সম্মিলিত প্রয়াসের ফল।

বিজ্ঞান ও সমাজের সম্পর্ক যত গভীর হচ্ছে, ততই দেখা যাচ্ছে নৈতিকতার প্রশ্নটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন যদি মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তবে তা সমাজে বৈষম্য, পরিবেশধ্বংস ও সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তাই বিশ্বজুড়ে এখন “Responsible Science” বা “Ethical Innovation” ধারণা গুরুত্ব পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো গবেষণায় নৈতিকতা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানের গুরুত্ব আরও সুস্পষ্ট। স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশ বিজ্ঞান শিক্ষা, কৃষি গবেষণা, তথ্যপ্রযুক্তি, ও স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন (SPARRSO), বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প প্রমাণ করে— আমরা বিশ্ব বিজ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তি ও দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের প্রয়োগে নজির সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বব্যাপী শিক্ষাঙ্গনে বিজ্ঞানচর্চা আজ সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তঃবিষয়ক গবেষণায় উৎসাহ দিচ্ছে, যেখানে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ও নৈতিকতা একত্রে মিলে বাস্তব সমস্যার সমাধান খোঁজে। শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞান উৎসব, প্রদর্শনী ও গণবিজ্ঞান কর্মসূচি চালু রয়েছে। এই প্রচেষ্টা নতুন প্রজন্মকে শেখাচ্ছে যে, বিজ্ঞান মানে কেবল সূত্র বা পরীক্ষা নয়— এটি এক জীবনদর্শন, যা মানুষকে প্রশ্ন করতে, ভাবতে ও পরিবর্তন আনতে শেখায়।

একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিজ্ঞানকে দিয়েছে নতুন সংজ্ঞা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিশ্ব অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করছে। একইসঙ্গে এগুলোর ব্যবহারিক ও নৈতিক দিক নিয়েও প্রশ্ন উঠছে— মানুষ কি প্রযুক্তির দাসে পরিণত হচ্ছে? এই প্রশ্নই বিজ্ঞানের নতুন দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করছে, যেখানে প্রযুক্তির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

অতএব, বিজ্ঞান আজ শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি মানবতার টিকে থাকার ভিত্তি। বৈজ্ঞানিক চিন্তা মানুষকে স্বাধীনতা দেয়— ভয়ের শৃঙ্খল ভেঙে সত্য অনুসন্ধানের সাহস জোগায়। এটি শেখায়, প্রতিটি অগ্রগতি তখনই অর্থবহ যখন তা মানুষের জীবনকে উন্নত করে, প্রকৃতিকে রক্ষা করে, এবং বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। বিজ্ঞানের এই মানবিক রূপই আগামী পৃথিবীর দিকনির্দেশক, যেখানে উন্নয়ন ও শান্তি একই স্রোতে প্রবাহিত হবে— জ্ঞান, যুক্তি ও দায়িত্ববোধের অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধনে।

ইউরোপে দিবসটি পালিত হয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিজ্ঞান জাদুঘরগুলোতে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির মতো দেশে এই দিনে অনুষ্ঠিত হয় বিজ্ঞান উৎসব, ওপেন ল্যাবরেটরি দিবস, ওয়ার্কশপ, এবং প্রদর্শনী— যেখানে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা সরাসরি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পান। ইউরোপীয় কমিশন ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি প্রায়ই এদিনে নতুন বৈজ্ঞানিক প্রকল্প বা গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশ অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য শক্তি বিষয়ে।

আমেরিকায় দিবসটি বিশেষভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বিদ্যালয়, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হয় বিজ্ঞান প্রদর্শনী, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও “সায়েন্স ফর পিস” সেমিনার। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এদিনে তরুণ গবেষকদের সম্মাননা প্রদান করে, যারা তাদের কাজের মাধ্যমে মানবকল্যাণে অবদান রাখছেন। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো— যেমন ব্রাজিল, চিলি, ও আর্জেন্টিনা— “বিজ্ঞান ও সমাজ” শীর্ষক আলোচনার মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান খোঁজার প্রয়াস চালায়।

এশিয়ায় দিবসটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় শিক্ষাঙ্গনে ও প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত— এসব দেশে সরকারিভাবে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের সঙ্গে শান্তি ও উন্নয়নের সম্পর্ক তুলে ধরতে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়। চীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়োজন করা হয় “সায়েন্স ফর সোশ্যাল হারমনি” সম্মেলন, যেখানে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে সামাজিক সমৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। ভারতে স্কুল পর্যায়ে “সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি” বিষয়ে প্রবন্ধ ও বিজ্ঞান প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যা তরুণ প্রজন্মকে বাস্তব জীবনের সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান ভাবতে উৎসাহিত করে।

আফ্রিকার দেশগুলোতে ইউনেস্কো ও স্থানীয় সরকারগুলো মিলে এদিনকে ব্যবহার করে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রসারে সচেতনতা তৈরি করতে। কেনিয়া, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ঘানা ও তানজানিয়ার মতো দেশে আয়োজিত হয় বিজ্ঞান মেলা, যেখানে স্থানীয় উদ্ভাবকরা তাদের কাজ উপস্থাপন করেন। অনেক দেশে এদিনে “সায়েন্স ইন রুরাল লাইফ” বা “বিজ্ঞান গ্রামে” শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানি ব্যবস্থাপনায় বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ শেখানো হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে দিবসটি শান্তি ও ধর্মীয় সহাবস্থানের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক তুলে ধরার এক অনন্য উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরবে আয়োজিত হয় আন্তর্জাতিক সেমিনার, যেখানে আলোচিত হয় ইসলামিক সভ্যতায় বিজ্ঞানের ঐতিহ্য এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক চেতনার সংমিশ্রণ। বিশেষ করে দুবাই ও দোহায় এদিনে তরুণ গবেষক ও নারী বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে দিবসটি পালিত হয় পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন থিমে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো “সায়েন্স ফর সাসটেইনেবিলিটি” প্রচারণা চালায়, যেখানে স্থানীয় জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক উদ্যোগে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হয়।

লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়া, ইউরোপ থেকে আফ্রিকা— সর্বত্র এই দিবসের উদ্দেশ্য একই থাকে: বিজ্ঞান যেন মানুষের জন্য হয়, আর তা যেন পৃথিবীকে আরও নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক করে তোলে। বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, সেমিনার বা গণআলোচনার মাধ্যমে একটি অভিন্ন বার্তা উচ্চারিত হয়— বিজ্ঞান কেবল আবিষ্কারের মাধ্যম নয়, এটি মানবতার পথনির্দেশক।

অতএব, বিশ্বের দেশে দেশে দিবসটি এখন কেবল এক দিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি জ্ঞানের বৈশ্বিক সংলাপের এক প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা বিজ্ঞানের মাধ্যমে শান্তি, সহাবস্থান ও টেকসই উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

বিশ্ব এখন এমন এক যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানবজীবনের প্রতিটি স্তরকে বদলে দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈবপ্রযুক্তি, ন্যানো-বিজ্ঞান, মহাকাশ অনুসন্ধান এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো ক্ষেত্রগুলো শুধু প্রযুক্তিগত নয়, মানবিক উন্নয়নেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে জিন থেরাপি ও প্রিসিশন মেডিসিন মানুষের আয়ু ও জীবনমান বৃদ্ধি করছে; কৃষিতে স্মার্ট ফার্মিং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করছে; আর তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি জ্ঞান ও শিক্ষাকে পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে।

তবে এই অগ্রগতি যেন মানবতার কল্যাণে ব্যবহৃত হয়— সেটিই মূল চ্যালেঞ্জ। বিজ্ঞান যদি নৈতিকতার আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তবে তা শান্তির পরিবর্তে সংঘাতও ডেকে আনতে পারে। তাই আজকের বিশ্বে প্রয়োজন এমন এক বৈজ্ঞানিক চেতনা, যা কেবল প্রযুক্তির নয়, মানবতারও বিকাশ ঘটায়। উন্নয়নের প্রকৃত রূপ তখনই সম্ভব, যখন বিজ্ঞানের শক্তি ব্যবহার হবে ন্যায়, সহমর্মিতা ও টেকসই জীবনের জন্য।

অতএব, মানবজীবনের প্রতিটি অগ্রগতির পেছনে বিজ্ঞান যেমন দিকনির্দেশনা দেয়, তেমনি তার দায়িত্বও নির্ধারণ করে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি তখনই অর্থবহ, যখন তা মানুষের জীবনকে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ করে তোলে— এটাই বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ অর্জন এবং মানবসভ্যতার চূড়ান্ত লক্ষ্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান, শান্তি ও উন্নয়নের সম্পর্কটি গভীর এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। একটি উন্নয়নশীল ও জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করছে, যেখানে বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে শিক্ষা, অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং প্রযুক্তি— সব ক্ষেত্রেই নবতর রূপান্তর ঘটছে। তাই এই ভাবনার মূল উদ্দেশ্য— বিজ্ঞানের মানবিক প্রয়োগ ও শান্তির ভিত্তিতে উন্নয়ন নিশ্চিত করা— বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশের অন্যতম বড় শক্তি হলো তার তরুণ প্রজন্ম। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশই তরুণ, যাদের অনেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অগ্রসর হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার বাস্তব রূপ এখন দেখা যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনের ডিজিটাল রূপান্তরে। স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সম্প্রসারণ, এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা তৈরির প্রচেষ্টা— সবকিছুই বিজ্ঞানের ওপর আস্থা ও বিনিয়োগের প্রতিফলন।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষি উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের ফলে বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতি থেকে আত্মনির্ভরতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞানীরা ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজসহ নানা ফসলে উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি, জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের জীবিকা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতেও বিজ্ঞানের অবদান সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ওষুধ উৎপাদন ও জনস্বাস্থ্য গবেষণায় আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছেন। করোনাভাইরাস মহামারির সময় স্থানীয় গবেষক ও চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় টেস্টিং, ভ্যাকসিন প্রয়োগ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এখন বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে— যা বিজ্ঞানের প্রয়োগের এক বড় সফলতা।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিজ্ঞান বাংলাদেশের জন্য এক অপরিহার্য হাতিয়ার। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু বিজ্ঞানের সহায়তায় বাংলাদেশ বিশ্বে “Climate Adaptation Model” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস, বন্যা ব্যবস্থাপনা, স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ, ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার— এসব ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়িয়েছে।

শিক্ষা ও সচেতনতায়ও বিজ্ঞানচর্চা এখন পরিবর্তনের অনুঘটক। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান মেলা, প্রকল্প প্রদর্শনী ও গবেষণা প্রতিযোগিতার আয়োজন তরুণদের মধ্যে উদ্ভাবনী চেতনা জাগিয়ে তুলছে। বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ানো ছাড়া ধর্মীয় কুসংস্কার, গুজব, ও ভুল তথ্য প্রতিরোধ সম্ভব নয়— এই বোধ সমাজে ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা মানুষের চিন্তা, বিশ্লেষণ ও বিচারক্ষমতাকে প্রসারিত করে, যা শান্তি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম পূর্বশর্ত।

বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতেও বিজ্ঞানের প্রভাব এখন বিস্ময়কর। তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার শিল্পে তরুণ উদ্যোক্তারা বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করছে। আইসিটি ডিভিশন, হাইটেক পার্ক অথরিটি, এবং স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সেন্টারগুলো বিজ্ঞানের প্রয়োগকে বাস্তব উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে রূপান্তর করছে। বিজ্ঞান এখন আর শুধু শিক্ষার বিষয় নয়, এটি কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— বিজ্ঞানের প্রয়োগকে শান্তি ও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করা। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা মানুষকে যুক্তিনিষ্ঠ ও সহনশীল করে তোলে, যা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক সহাবস্থানেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল যদি নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপিত হয়, তবে দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা বিস্তার ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাস্তব অগ্রগতি অর্জন সম্ভব।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণার গুরুত্ব বহুমাত্রিক— এটি তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে, অর্থনীতিকে বিজ্ঞাননির্ভর পথে চালিত করে, সমাজকে যুক্তিনিষ্ঠ করে তোলে এবং দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে। বিজ্ঞান, শান্তি ও উন্নয়নের এই ত্রয়ী সম্পর্ককে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করা গেলে বাংলাদেশ কেবল প্রযুক্তিগত নয়, মানবিক উন্নয়নের দিক থেকেও এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করতে পারবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।