নারী উদ্যোক্তার উত্থান: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক রূপান্তরের নতুন অধ্যায়
ওয়াজেদুর রহমান কনক
নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও উদ্যোক্তা সক্ষমতার উন্নয়ন গত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক–অর্থনৈতিক রূপান্তরগুলোর একটি। এই রূপান্তরকে একটি সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক আন্দোলনের রূপ দিতে ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে শুরু হয় Women’s Entrepreneurship Day (WED)। দিনটি সাধারণ কোনো উদযাপন নয়; এটি মূলত বিশ্বব্যাপী নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, নীতি–প্রভাব, উন্নয়ন কাঠামো এবং বাজার–সক্ষমতা বৃদ্ধির সমগ্র সংগ্রামকে একটি বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা। উন্নয়ন অর্থনীতি, শ্রমবাজার তত্ত্ব, জেন্ডার স্টাডিজ, উদ্যোক্তা তত্ত্ব এবং আন্তর্জাতিক নীতি–বিশ্লেষণের মিলনে WED হয়ে উঠেছে এক বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম, যা নারীর উদ্যোক্তা সক্ষমতার পৃথক সামাজিক, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধাগুলোকে শনাক্ত করে এবং নীতিনির্ধারণী স্তরে তা মোকাবিলার পথ দেখায়।
নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের মূল দর্শন হলো—অর্থনীতির উৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলোতে নারীর প্রবেশ, অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব কেবলমাত্র একটি লিঙ্গসমতার বিষয় নয়; বরং এটি দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানবসম্পদ উন্নয়নের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির বৈচিত্র্য বৃদ্ধির একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএন–উইমেন ও জেন্ডার–ইকোনমিক্স গবেষণাগুলো দেখায় যে নারীর নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (SME) কোনো দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, যদিও তাদের সামনে আর্থিক পুঁজি প্রাপ্তি, বাজারে প্রবেশ, প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে চ্যালেঞ্জ থেকে যায়। এই বাস্তবতায় WED প্রতিষ্ঠা করে যে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন একটি কাঠামোগত অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে এবং এটি কেবল ব্যক্তিগত উন্নতি নয় বরং সামষ্টিক উন্নয়নের শক্তিশালী ইঞ্জিন।
এই উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী ১৪৪টিরও বেশি দেশে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনুষ্ঠান, সম্মেলন, নীতি–সংলাপ, চুক্তি, বিনিয়োগ–মেলা, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তি–উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি নেয়া হয়। এতে অংশ নেন বিশ্বনেতা, নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন কর্মীরা। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে যে প্রবল নেটওয়ার্কিং গড়ে ওঠে তা পৃথিবীর এক কোণ থেকে অন্য কোণে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সফল ব্যবসা মডেলের বিনিময় ঘটায়। একইসঙ্গে এটি স্থানীয় পর্যায়ের নারীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কাঠামোর সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে, যা টেকসই উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেম গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
উদ্যোক্তা–অর্থনীতি গবেষণা দেখায়, সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী উদ্যোক্তা পরিসরে যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করলে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে ৩০–৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে নারীরা এখনো প্রযুক্তি–নির্ভর ব্যবসা, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্টার্টআপ এবং মূলধনী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা বাঁধার মুখে পড়ে। Women’s Entrepreneurship Day এই কাঠামোগত বৈষম্যগুলো শনাক্ত করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণপ্যাকেজ, ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং, ব্যবসা নিবন্ধন সহজীকরণ, নারীর মালিকানাধীন ব্যবসাকে সরকারি ক্রয়ে অগ্রাধিকার, এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের ওপর জোর বৃদ্ধি পাওয়া এই দিনের প্রভাবের অংশ।
এ আন্দোলন আরও একটি দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আনে—উন্নয়নশীল বিশ্বে উদ্যোক্তা কার্যক্রম শুধু বাজারে অংশগ্রহণ নয়; বরং নারীর সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের প্রশ্ন। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে নারী উদ্যোক্তা মানেই পরিবারের আর্থিক স্বনির্ভরতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, এবং সমাজে নেতৃত্বের উদ্গমন—যা উন্নয়ন তত্ত্বে ‘gendered transformation’ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়া পরিবার, বাজার ও রাষ্ট্র—তিন স্তরেই নারীর ভূমিকাকে পুনর্গঠিত করে। তাই WED কেবল উদ্যোক্তা উন্নয়নের দিবস নয়, এটি বৈশ্বিক জেন্ডার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার একটি আন্দোলন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটির গুরুত্ব অসাধারণ। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা, হস্তশিল্প, ডিজিটাল স্কিল, এবং ক্ষুদ্র খুচরা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। তবে মূলধন প্রাপ্তি, প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা, পারিবারিক বাধা, বাজারে প্রবেশ এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা বড় চ্যালেঞ্জ। Women’s Entrepreneurship Day এই চ্যালেঞ্জগুলোকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনায় তুলতে সহায়তা করে এবং নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে রাষ্ট্র, এনজিও, ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গঠনে অনুপ্রাণিত করে। বিশেষ করে দেশে নারী উদ্যোক্তাদের একটি সুবিশাল ডিজিটাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে—যা উন্নয়ন গবেষণায় ‘informal-to-formal transition’ হিসেবে বিবেচিত। এই রূপান্তরকে যথাযথ নীতি–সহায়তা দিলে নারী নেতৃত্বাধীন SME খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারে।
সব মিলিয়ে Women’s Entrepreneurship Day শুধু একটি দিন নয়—এটি এক বৈশ্বিক নারীমুক্তির অর্থনৈতিক দর্শন, একটি নীতিনির্ধারণী কাঠামো, উদ্যোক্তা সক্ষমতার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, এবং ভবিষ্যতের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির রূপরেখা। সমসাময়িক উন্নয়ন তত্ত্ব এবং জেন্ডার–ইকোনমিক্সের দৃষ্টিতে এটি টেকসই অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দিনটি বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে যাত্রার প্রতীক হয়ে রয়েছে।
Women’s Entrepreneurship Day মূলত বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে গঠিত এক বৈশ্বিক নীতি–আন্দোলন, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নারীর উদ্যোক্তা ক্ষমতাকে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসা। এই দিবসটির জন্ম হয় এমন এক সময়ে, যখন উন্নয়ন অর্থনীতি ক্রমশ স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে যে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন কেবলমাত্র মানবাধিকার বা লিঙ্গসমতার প্রশ্ন নয়; বরং এটি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই উন্নয়নের সবচেয়ে কার্যকর চালিকাশক্তিগুলোর একটি। সুতরাং দিবসটির উদ্দেশ্য কেবল উৎসব নয়—বরং নারীর উদ্যোক্তা সম্ভাবনাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, নীতিগত অগ্রাধিকার এবং বৈশ্বিক জ্ঞানভিত্তিক সহায়তার মাধ্যমে এমনভাবে প্রসারিত করা, যা অর্থনীতির কাঠামো নিজেই পরিবর্তন করতে সক্ষম।
এই দিবসটি নারীর উদ্যোক্তা যাত্রাকে যে বহুমাত্রিক বাধা ঘিরে রেখেছে—যেমন আর্থিক পুঁজির অভাব, বাজারে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা, প্রযুক্তিতে অসম 접근, সামাজিক রীতিনীতির প্রতিবন্ধকতা এবং নীতিগত প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি—সেসব বাধাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্যটি তাই দ্বিমুখী: একদিকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাস্তবভিত্তিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, নেটওয়ার্কিং, বিনিয়োগ এবং বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি; অন্যদিকে সরকার, ব্যাংকিং খাত, উন্নয়ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি সেক্টরের কাছে জেন্ডার–সংবেদনশীল অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত পরিবর্তনের পথ তৈরি করা।
Women’s Entrepreneurship Day-এর অন্যতম গভীর উদ্দেশ্য হলো নারী উদ্যোক্তা শক্তিকে একটি বৈশ্বিক জ্ঞান–সম্পদে রূপান্তর করা—যেখানে এক দেশের সফল ব্যবসা মডেল, উদ্ভাবন বা নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অন্য দেশের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা ও শিক্ষার উৎস হয়ে ওঠে। এই আন্তঃদেশীয় অভিজ্ঞতা বিনিময় একটি বৈশ্বিক নারী অর্থনীতি নির্মাণের ধারণাকে শক্তিশালী করে, যা আধুনিক বিশ্বায়নের কাঠামোর সঙ্গে নারীর অংশগ্রহণকে সংযুক্ত করে।
এর পাশাপাশি দিবসটির উদ্দেশ্য নৈতিক ও সামাজিক—নারীর স্বাধীনতা, সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার, পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা এবং আত্মপরিচয়ের বিকাশকে অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা। এটি এমন একটি বার্তা দেয় যে নারীর উদ্যোক্তা কর্মকাণ্ড কেবল অর্থের লেনদেন নয়; এটি ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। তাই WED অর্থনীতির পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, লিঙ্গতাত্ত্বিক গবেষণা এবং উন্নয়ন তত্ত্বের একটি যৌথ মঞ্চ হিসেবেও কাজ করে।
সব মিলিয়ে, Women’s Entrepreneurship Day-এর উদ্দেশ্য হলো নারীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বৈশ্বিক উন্নয়ন কাঠামোর অপরিহার্য অংশে পরিণত করা—যেখানে নারী উদ্যোক্তা আর প্রান্তিক শক্তি নয় বরং সমাজ–রাষ্ট্র–বাজার মিলিত আধুনিক অর্থনীতির কেন্দ্রে অবস্থান করেন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দিবসটি বিশ্বব্যাপী এক বৃহৎ অভিযাত্রা—যা আগামী প্রজন্মের নারীদের জন্য আরও সমতা, সক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ একটি পৃথিবী নির্মাণের প্রতিশ্রুতি বহন করে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘ পথচলায় নারীর উদ্যোক্তা কার্যক্রম একটি তুলনামূলক নবীন কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী গতিশীলতার ধারক। গত তিন দশকে পোশাকশিল্প, এনজিও–মাইক্রোক্রেডিট, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম–নির্ভর বাণিজ্যের ফলে যে সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টি হয়েছে, তার ভিত গড়ে দিয়েছে নারী শ্রম ও নারী উদ্যোক্তা চেতনা। এই প্রেক্ষাপটে Women’s Entrepreneurship Day (WED) বাংলাদেশের নারী–অর্থনীতির জন্য কেবল একটি স্মরণোৎসব নয়; এটি রাষ্ট্র, সমাজ, বাজার এবং বৈশ্বিক নীতি–অঙ্গনের সঙ্গে বাংলাদেশের নারীর অর্থনৈতিক অবস্থানকে নতুনভাবে চিহ্নিত করার একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তারা ঐতিহ্যগতভাবে সীমাবদ্ধ ছিলেন ক্ষুদ্র হস্তশিল্প, কৃষিজ পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেলাই–কাজ বা গৃহভিত্তিক উৎপাদনে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধ পরিসরটি এখন ধীরে ধীরে একটি বহুমাত্রিক ব্যবসায়িক ইকোসিস্টেমে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির ফলে তৈরি হওয়া ই–কমার্স, ফেসবুক–ভিত্তিক বাণিজ্য, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, মোবাইল ফিনটেক, ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অনলাইন ব্র্যান্ডিং–এর বিস্তার নারী উদ্যোক্তাদের একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলেছে, যাদের পরিচয় আর কেবল ‘গৃহভিত্তিক উদ্যোগ’ নয় বরং আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, বাজারমুখী, এবং পুঁজিনির্ভর ব্যবসায়িক কার্যক্রম। WED এই উদীয়মান শ্রেণিকে আন্তর্জাতিক পরিসর ও বৈশ্বিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে, ফলে তাদের কাজ কেবল স্থানীয় বা পারিবারিক অর্থনীতি নয়, বরং জাতীয় উৎপাদন কাঠামোর অংশ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা বিকাশের সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলধন প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা, ব্যাংকিং জটিলতা, সম্পত্তির মালিকানায় বৈষম্য, বাজারে প্রবেশের সমস্যা, পারিবারিক দায়িত্বের ভারসাম্য এবং ব্যবসা পরিচালনার সামাজিক–সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা। WED–এর গুরুত্ব এখানেই—এটি জাতীয় নীতি–পর্যায়ে এই কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে আলোচনায় নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নারী উদ্যোক্তা বিশেষ ঋণপ্যাকেজ, SME ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ, সরকারি ক্রয়ে নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার, নারীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য কর–ছাড়, এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর–বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো এই আন্তর্জাতিক দিনটিকে কেন্দ্র করে নতুন করে মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনার সুযোগ পায়। নীতি গবেষণার দৃষ্টিতে এটি হলো লিঙ্গনির্ভর উন্নয়ন কাঠামোকে অর্থনৈতিক নীতির মূলধারায় প্রবেশ করানোর একটি ধাপে ধাপে দৃশ্যমান প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নকে বুঝতে হলে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে পার্থক্যটিও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো কৃষি ও ক্ষুদ্র উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল; কিন্তু শহুরে নারী উদ্যোক্তারা ডিজিটাল বাজার, সেবা–ভিত্তিক স্টার্টআপ, আইটি–ভিত্তিক ব্যবসা এবং ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে বেশি সক্রিয়। WED এই ভৌগোলিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যকে সমন্বিতভাবে তুলে ধরে একটি জাতীয় বয়ান তৈরি করে—যেখানে নারী উদ্যোক্তা কেবল অর্থনৈতিক এজেন্ট নয়, বরং সমাজের রূপান্তরকারী শক্তি। উন্নয়ন গবেষণায় এ ধরনের রূপান্তরকে বলা হয় gendered economic restructuring, যার ফলে পরিবার, শ্রমবাজার এবং স্থানীয় অর্থনীতি নতুনভাবে সংগঠিত হয়।
বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা সামাজিকভাবে শুধুমাত্র একটি সুযোগের প্রয়োজন অনুভব করেন না; অনেক ক্ষেত্রেই তারা পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তার প্রধান বাহক হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নারীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মভিত্তিক ছোট উদ্যোগকে পারিবারিক জীবনের সঙ্গে মানানসই অর্থনৈতিক সমাধান হিসেবে ব্যবহার করছেন। WED এই অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় অনুবাদ করে—যেখানে নারী উদ্যোক্তাকে কেবল ক্ষুদ্র উৎপাদক হিসেবে নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির অংশীজন হিসেবে দেখা হয়, যাদের উন্নয়নে বিনিয়োগ করা মানে শ্রমবাজারের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক ক্যাপিটাল শক্তিশালী করা।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ডিজিটাল সাক্ষরতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। নারীর প্রযুক্তি ব্যবহারে অসুবিধা, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, সাইবার নিরাপত্তা সমস্যা এবং অনলাইন হয়রানির মতো চ্যালেঞ্জগুলো উদ্যোক্তা পরিবেশে বড় প্রভাব ফেলে। Women’s Entrepreneurship Day প্রযুক্তি–ভিত্তিক নিরাপদ পরিবেশ তৈরির বিষয়ে বৈশ্বিক আলোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে একটি আন্তর্জাতিক রেফারেন্স–ফ্রেম প্রদান করে—যেখানে ডিজিটাল নারী উদ্যোক্তা সুরক্ষা, ডেটা–অ্যাক্সেস, অনলাইন বাজারজাতকরণ এবং ই–কমার্স রেগুলেশনের আধুনিকীকরণ নিয়ে আরও গভীর নীতি আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর উদ্যোক্তা উন্নয়ন বাংলাদেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম। SME খাতে নারীর অংশগ্রহণ যদি দ্বিগুণ করা যায়, তাহলে দেশের উৎপাদনশীলতা এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে দৃশ্যমাণ বৃদ্ধি ঘটতে পারে—এটি বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নারী–অর্থনীতি গবেষণায় স্পষ্ট। WED এই সম্ভাবনাকে নীতি–নির্ধারক ও বেসরকারি খাতের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করে, ফলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, রপ্তানি–সহায়তা এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের পথ তৈরি হয়।
বাংলাদেশে নারীর উদ্যোক্তা আন্দোলন একটি সামগ্রিক সমাজ–অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ—যেখানে নারীর পরিচয় কর্মসংস্থানের পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে নেতৃত্ব, সৃজনশীলতা, পুঁজি ব্যবস্থাপনা এবং বাজার সম্প্রসারণের ধারণাকে ধারণ করছে। Women’s Entrepreneurship Day এই বিবর্তনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এটি এমন একটি বৈশ্বিক দিন, যা বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা এবং সামাজিক বৈধতা প্রদান করে; একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেয় যে নারীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা বিকাশকে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতি–দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে নারীর উদ্যোক্তা–পরিবেশকে বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ দিয়ে নয় বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের অংশ হিসেবে দেখা হবে। এই কাজটি শুরু হয় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য উপযোগী অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে—যেখানে ঋণ, বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, বাজার এবং ব্যবসা পরিচালনার প্রশাসনিক সহায়তা সমানভাবে উপলব্ধ থাকবে। ব্যাংকিং খাতে নারী উদ্যোক্তাদের প্রবেশগম্যতা উন্নত করতে হলে প্রয়োজন সহজতর নীতিমালা, জামানতবিহীন বা কম জামানত–ভিত্তিক ঋণ, সুদের হারে রেয়াত, এবং নারী–কেন্দ্রিক বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ। একই সঙ্গে ব্যবসায়িক নথিপত্র, লাইসেন্সিং, ট্যাক্স রিটার্ন, ট্রেড লাইসেন্স কিংবা রপ্তানি–সংক্রান্ত প্রশাসনিক জটিলতা কমাতে না পারলে নারী উদ্যোক্তারা কখনোই ‘ক্ষুদ্র উদ্যোগ’ থেকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে’ উত্তরণ ঘটাতে পারবেন না।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা বিকাশের একটি কেন্দ্রীয় করণীয় হলো প্রযুক্তিকে নারীর হাতের নাগালে নিয়ে আসা। ই–কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং, মোবাইল পেমেন্ট, অনলাইন ব্র্যান্ডিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট এবং ক্লাউড–ভিত্তিক ব্যবসা ব্যবস্থাপনার মতো প্রযুক্তি এখন ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু প্রযুক্তিগত লজ্জা, দক্ষতার ঘাটতি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক নারী এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দ্বিধাগ্রস্ত। তাই প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে নারী–কেন্দ্রিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, সাইবার–সুরক্ষার নিশ্চয়তা, এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তার সক্ষমতা তৈরি—এমনভাবে যাতে প্রতিটি উপজেলায় একটি “Women Digital Business Hub” গড়ে ওঠে, যেখানে নারী উদ্যোক্তারা প্রযুক্তি শিখতে, বাজার খুঁজতে এবং ব্যবসা পরিচালনা করতে বাস্তবসম্মত সহায়তা পান।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাজার সম্প্রসারণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, কিন্তু নারীরা এখনো বাজারে প্রবেশ ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে বৈষম্যের মুখোমুখি হন। এটি সমাধানে প্রয়োজন নারী–উদ্যোক্তা পণ্যকে সরকারি ক্রয়ে অগ্রাধিকার প্রদান, স্থানীয় ও জাতীয় মেলা–উদ্যোগে নারী–অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের রপ্তানি–সক্ষমতা গড়ে তোলা। বিশেষ করে হস্তশিল্প, খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত পণ্য, ফ্যাশন ডিজাইন, আগ্রো–বিজনেস এবং তথ্যপ্রযুক্তি–নির্ভর উদ্যোগগুলোকে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিংয়ের আওতায় আনতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সহযোগিতা অপরিহার্য।
নারীর উদ্যোক্তা–যাত্রার অন্তরালে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতাও রয়ে গেছে—যেখানে পরিবারের সমর্থন, কর্মজীবন–পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য, ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণ, এবং নেতৃত্বের সুযোগ সীমিত। সুতরাং করণীয় হলো নারী উদ্যোক্তা নয়, বরং পরিবার ও সমাজকে লক্ষ্য করে সচেতনতা নির্মাণ—যাতে উদ্যোক্তা হওয়া নারীর জন্য ব্যতিক্রম নয়, স্বাভাবিক একটি পথ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়া, ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্ব, এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতি—সব জায়গায় নারী উদ্যোক্তার ইতিবাচক বয়ানকে প্রাতিষ্ঠানিক করা গেলে সমাজের মনস্তত্ত্ব বদলে যাবে, যা অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত করবে।
নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে গবেষণা ও ডেটাভিত্তিক নীতি–পরিকল্পনা আরেকটি জরুরি করণীয়। বাংলাদেশে নারী–উদ্যোক্তা বিষয়ে নির্ভুল তথ্য এখনো দুর্লভ; অনেক সরকারি নথিতে নারী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করে চিহ্নিতই করা হয় না। ফলে নীতি–প্রণয়ন অনেকাংশে আন্দাজনির্ভর থাকে। তাই করণীয় হলো জাতীয় পর্যায়ে একটি নারী–উদ্যোক্তা ডেটাব্যাংক প্রতিষ্ঠা, যেখানে উদ্যোক্তার সংখ্যা, খাতভিত্তিক বণ্টন, বাজারে অংশগ্রহণ, আয়ের স্তর, প্রযুক্তি ব্যবহার, রপ্তানি সক্ষমতা, বাধা ও সম্ভাবনা—সব কিছু নিয়মিত আপডেট থাকবে। এই ডেটা ভবিষ্যতের নীতি–পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন বিনিয়োগকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করবে।
সবশেষে করণীয় হলো নারী উদ্যোক্তাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করা। আধুনিক উদ্যোক্তা–জগতে ‘নেটওয়ার্কিং’ শুধু সম্পর্ক নয়, বরং নতুন বাজার, বিনিয়োগ, জ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রবেশদ্বার। Women’s Entrepreneurship Day–এর আন্তর্জাতিক কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে যদি বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে যৌথ প্রকল্প, ডিজিটাল লার্নিং, আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ, স্টার্টআপ বিনিয়োগ সংযোগ এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় প্রতিষ্ঠা করতে পারে—তাহলে বাংলাদেশের নারী অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী এক নতুন পরিচয় লাভ করবে।
নারী উদ্যোক্তার অগ্রযাত্রা কেবল ব্যক্তির উন্নয়ন নয়; এটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন–বিমূর্তিকে পরিবর্তন করার মতো শক্তিশালী সামাজিক প্রক্রিয়া। করণীয় হলো এমন একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক–সামাজিক–প্রযুক্তিগত কাঠামো তৈরি করা, যেখানে একজন নারী ব্যবসা শুরু করা, পরিচালনা করা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিযোগিতা করার জন্য যেসব সহায়তা প্রয়োজন—সবই তিনি সহজে এবং সম্মানের সঙ্গে পাবেন।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
