ইটভাটা ভাঙার অর্জন ও মানুষের ভাঙা স্বপ্ন, এক বিষণ্ণতার ইশতেহার
মো. ইমদাদুল হক সোহাগ
সকালে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে যখন মাননীয় পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য শুনছিলাম, তখন একটি বাক্য কানে বাজছিল। উপদেষ্টা বললেন, ‘এ বছর আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো আমরা রেকর্ড সংখ্যক ইটভাটা ভেঙেছি।’
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সভাকক্ষের সুরক্ষিত পরিবেশে এই ঘোষণাটি নিছক এক সাফল্যের পরিসংখ্যান। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী মহল এবং সচেতন নাগরিকের কাছে নিঃসন্দেহে এটি ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ হতে পারে। তবে এ বিজয়ের আড়ালে যে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের জীবন, স্বপ্ন, এবং জীবিকা এক লহমায় চূর্ণ হলো, সেই চাপা কান্নার প্রতিধ্বনি কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাঁচের দেয়াল ভেদ করে প্রবেশ করতে পারে না। এই প্রবন্ধ সেই অদৃশ্য কান্নার দলিল—যেখানে ইটভাটা ভাঙার নীতি বাস্তবায়িত হয়, কিন্তু শ্রমিকের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়।
১. বিষণ্ণতার নিঃশ্বাস: মানবিক বিপর্যয়ের আড়ালে অর্জন ঘোষণা: গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই ইটভাটাগুলো বছরের পর বছর ধরে হাজারো পরিবারের মৌসুমি আয়ের মূল উৎস। বুলডোজার যখন কোনো ভাটার উঁচু চিমনিকে মরমর করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, তখন শুধু নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ ধসে পড়ে না; ভেঙে যায় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক চক্র, সামাজিক নির্ভরতার ভিত্তি এবং একটি পরিবারের আগামী ছয় মাসের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
ভাটা ভাঙার নির্দেশটি প্রশাসনের কাছে একটি 'টার্গেট পূরণ' হলেও, এর মানবিক মূল্য অনেক বেশি। একজন ফায়ারম্যানের কাছে তা সদ্য কেনা গরুর দুধ বিক্রির আশার বিনাশ, একজন ছাঁচকারের কাছে সন্তানের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হওয়ার ভয়, আর এক ট্রলিচালকের কাছে অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ কেনার অক্ষমতা। এগুলো কোনো বিমূর্ত পরিসংখ্যান নয়, এগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন থেকে উৎসারিত নির্জলা সত্য, যা বিষণ্ণতার নিঃশ্বাসে ভারী।
একজন শ্রমিক নেতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন—"আমরা ইট বানাই, কিন্তু ভাটা ভাঙার দিন আমাদের নিজের ঘরটাই যেন ভেঙে যায়।" নীতি যখন শুধু বুলডোজারের শক্তি দিয়ে তার সফলতা পরিমাপ করে, তখন মানবিকতার সূচক শূন্যে নেমে আসে। এই অভিযান তাই সাফল্যের নয়, এটি নীতির মানবিক অসফলতার একটি তিক্ত ইশতেহার।
২. পরিবেশ রক্ষার সীমাবদ্ধতা ও নীতির শূন্য-সমষ্টির খেলা: ইটভাটা যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কালো ধোঁয়া, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম {২.৫.}) নিঃসরণ জনস্বাস্থ্য ও কৃষি অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ। ভাটা বন্ধ হলে স্থানীয় বায়ুর গুণগত মান সাময়িকভাবে উন্নত হয়—এসব সুফল অবশ্যই প্রশংসনীয়।
তবে এই অর্জনের সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচনা করা অত্যাবশ্যক। পরিবেশবাদী সংস্থাগুলো মনে করে, ভাটা বন্ধ হলেও ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের সামগ্রিক দূষণচিত্রে এর প্রভাব প্রায়শই সামান্য থাকে, কারণ দূষণের প্রধান কারণগুলির মধ্যে এখন মোটরগাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলো এবং অন্যান্য শিল্পকারখানাই প্রধান।
সবচেয়ে বড় নীতিগত ত্রুটি হলো—ইটের চাহিদা কিন্তু কমছে না। ফলে ভাটা বন্ধ হওয়ায় সেই চাহিদা মেটাতে পার্শ্ববর্তী বা দুর্বল নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবৈধ ভাটার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যায়, যা প্রকারান্তরে পরিবেশের ঝুঁকিকে স্থানান্তর করে মাত্র। নীতি নির্ধারকরা কেবল 'ভাঙার' ওপর জোর দিলেন, কিন্তু 'রূপান্তরের' ওপর নয়। বিশ্বব্যাংক সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, যদি হাইব্রীড হফম্যান কিন (এইচএইচকে) বা ব্লক উৎপাদনে রূপান্তরের সুযোগ দেওয়া হতো, তবে দূষণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে একইসঙ্গে কর্মসংস্থানও রক্ষা করা যেত। কেবল ভাঙার নীতি তাই 'শূন্য-সমষ্টির খেলা' হয়ে থাকল—যেখানে এক পক্ষ (পরিবেশ) জয়ী হলেও অন্য পক্ষকে (জীবিকা) ধ্বংস হতে হলো।
৩. ন্যায়ভিত্তিকতার অভাব ও নীতির বৈষম্যমূলক প্রয়োগ: উপদেষ্টার 'রেকর্ড সংখ্যক ভাটা ভাঙার' ঘোষণাটি নীতির বাস্তবায়নে ন্যায়ভিত্তিকতা (জাস্টিস) ও পক্ষপাতহীনতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা হলো, এই ভাঙার নীতিটি সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর হয়নি। দেখা যায়, যে ইটভাটাগুলো রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, বা যার মালিকের ক্ষমতা কম, সেই ভাটাগুলোই সবচেয়ে আগে এবং নির্মমভাবে ভাঙার শিকার হয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী মহল দ্বারা পরিচালিত ভাটাগুলো বহু ক্ষেত্রেই আইনের ফাঁক গলে চলতে থাকে।
এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ছোট, পুঁজিহীন উদ্যোক্তারা সহজেই হার মানেন। অথচ বড় শিল্প গোষ্ঠীগুলির ভাটা, যাদের রূপান্তরের সক্ষমতা আছে, তারা প্রভাব খাটিয়ে চলতে থাকে। ভাঙার নীতিটি ন্যায়ভিত্তিক না হওয়ায়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই শ্রমিক যাদের এই অন্যায়ে কোনো ভূমিকা নেই। এই অর্জন তাই পরিবেশ রক্ষার অর্জনের চেয়েও বেশি—নীতির অপপ্রয়োগ এবং বৈষম্যের এক তিক্ত দৃষ্টান্ত। ভাটা ভাঙা মানেই সাফল্য নয়; শ্রমিকের জন্য বিকল্প জীবিকার পথ খুলে দেওয়াটাই প্রকৃত অর্জন হতো।
৪. শ্রমিকের হৃদয়ের কান্না: ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ এর চরম অবহেলা: ইটভাটা ভাঙা সরকারের একটি সাফল্য হলেও, শ্রমিকের কাছে তা চরম ব্যর্থতা। হঠাৎ কাজ বন্ধ হওয়ায় তাদের কাঁধের ওপর পুরো পরিবারের ভার চেপে বসে। ভাটা শিল্প যেহেতু মৌসুমি আয়ের উৎস, তাই মৌসুমের মাঝখানে কাজ বন্ধ হলে এই শ্রমিকদের হাতে কোনো সঞ্চয় থাকে না। ‘আগুন নিভে গেলে আমাদের চুলাও নিভে যায়,’—এই সরল সত্যটি রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় স্থান পায় না।
হঠাৎ বেকার হয়ে পড়া বিশাল সংখ্যক মানুষ জীবনধারণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা বস্তি জীবনে পাড়ি জমায় অথবা স্বল্প মজুরির ঝুঁকিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে একটি পরিবেশগত সমস্যা রূপান্তরিত হয় সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা সংকটে।
‘জাস্ট ট্রানজিশন’ বা ন্যায়ভিত্তিক রূপান্তরের মূল কথা হলো—পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের মানবিক বা সামাজিক খরচ যেন কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে বহন করতে না হয়। কিন্তু ইটভাটা ভাঙার নীতিতে শ্রমিকদের জন্য কোনো সামাজিক সুরক্ষা জাল, দক্ষতা উন্নয়ন বা পুনর্বাসন পরিকল্পনা রাখা হয়নি। এই নীতি যেন কেবল "ভাঙো এবং ভুলে যাও" স্লোগানে পরিচালিত হয়েছে।
৫. উপসংহার: নীতি ও মানবিকতার চূড়ান্ত পরীক্ষা: উপদেষ্টার ঘোষণা হয়তো একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেই রেকর্ডের নিচে চাপা পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের নীরব কান্না। যে উন্নয়নে মানুষ কাঁদে, যে অর্জনে শ্রমিক তার জীবিকা হারায়, সেই উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না।
আমাদের নীতিকে প্রমাণ করতে হবে যে—ভাটা ভাঙা মানেই কেবল পরিবেশ রক্ষা নয়, ভাটা ভাঙা মানে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা।
মাননীয় উপদেষ্টা, আপনার প্রতি একটি বিনীত প্রশ্ন
ইটভাটা যখন আপনি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন, তখন কি আপনি সেই শ্রমিকের পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছেন, যে তার অসুস্থ মাকে ওষুধ পাঠাতে চেয়েছিল? যে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিল "বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেবো"? যখন সে দেখে তার কর্মস্থান বিলীন হয়ে যাচ্ছে—সেই মুহূর্তে তার বুকে যে হাহাকার, আপনি কি তা কল্পনা করেছেন?
আপনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় পরিবেশবিদ। আপনার উচিত ছিল সবার আগে দুঃখী মানুষের কষ্টগুলো বোঝা, রূপান্তরের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে যেতে উদ্যোক্তাদের ভর্তুকি ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে যদি এই অর্জন ঘোষণা করতেন, তবে তা প্রকৃত অর্জন হতো।
মানুষ, পরিবেশ ও নীতির সমন্বয়ে যে অর্জন হয়, সেটাই হোক আমাদের প্রকৃত এবং টেকসই সাফল্য।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক ও সমাজ সংস্কারক।
