ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিশ্ব রাজনীতির জটিলতা, সংঘাত আর ক্ষমতার টানাপোড়েনের ভিড়ে অনেক সময় কিছু ঘটনা আমাদের মানবিক চেতনার সামনে বড় প্রশ্ন তুলে ধরে—আমরা কি সত্যিই মানুষ? প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস ঠিক সেই প্রশ্নটিকেই নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। প্রতি বছর ২৯ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী এই দিনটি পালন করা হয় নিপীড়িত প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সংহতি জানাতে, তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে সমর্থন করতে এবং ন্যায়বিচারের পথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অঙ্গীকারকে পুনর্ব্যক্ত করতে।

দিবসের ইতিহাস

১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২৯ নভেম্বরকে “International Day of Solidarity with the Palestinian People” হিসেবে ঘোষণা করে। এই তারিখটি চয়ন করা হয়েছিল প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি বৈধ অধিকার—স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, নিরাপদ জীবন এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণ—এর প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে। এরপর থেকে প্রতি বছর এই দিনটি বিশ্বজুড়ে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হয়—সেমিনার, আলোচনাসভা, মানববন্ধন, প্রদর্শনী—যা নিপীড়িত জনগণের কষ্টকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরার একটি প্রভাবশালী মাধ্যম।

এই দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়; এটি মানবতার ডাক, ন্যায়বিচারের আহ্বান, আর এক অসমাপ্ত ক্ষতকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কোনও জাতি বা জনগণ যদি দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হয়, তাহলে তার গল্পকে অবহেলা করা মানবতার প্রতি অবহেলার সমতুল্য।

ইতিহাসের পাতায় প্যালেস্টাইনের বেদনা

প্যালেস্টাইনের জনগণের দুর্দশা নতুন নয়; এটি দশকের পর দশক ধরে চলমান। ১৯৪৮ সালের বিভক্তি, বাস্তুচ্যুতি, দখলদারিত্ব, সামরিক নিপীড়ন—সব মিলিয়ে প্যালেস্টাইনের ইতিহাস হয়ে গেছে বেদনার ইতিহাস। ঘরবাড়ি হারানো মানুষ, আত্মীয় হারানো শিশু, যুদ্ধের শব্দে আতঙ্কিত পরিবার, খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে ভোগা জনগণ—এসবই আজ বাস্তবতা।

বছরের পর বছর ধরে নানা শান্তি উদ্যোগ, জাতিসংঘের প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক বিবৃতি এসেছে, কিন্তু মাটির মানুষের জীবনে খুব কম পরিবর্তন এসেছে। তারা এখনও সেই অধিকারটিই চায়—নিজের দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। প্রতিটি ঘর, প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি শিশু—সবাই এই দীর্ঘ যন্ত্রণার সাক্ষী। পরিবারগুলো শিক্ষার স্বাভাবিক সুযোগ হারাচ্ছে, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ছে, এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা সীমিত হচ্ছে।

সহমর্মিতা মানে কেবল দুঃখ নয়

সহমর্মিতা মানে শুধু কষ্ট দেখে কান্না করা নয়। এটি একটি সক্রিয় চেতনা, যা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং মানবাধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার মধ্যে প্রকাশ পায়।

প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে সহমর্মিতা আরও গভীর, কারণ তারা শুধু একটি যুদ্ধের সম্মুখীন নয়; তারা পুরো প্রজন্ম ধরে একটি বৈষম্যমূলক বাস্তবতার শিকার। আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা তাই তাদের শক্তি জোগায়, তাদের সংগ্রামকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেয়।

কেন বিশ্ব এই দিনটি পালন করে?

প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি যে অবিচার চলছে তা শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডগত সমস্যা নয়; এটি মানবাধিকারের সমস্যা। আজকের পৃথিবীতে যখন একটি শিশুও নিজের জন্মভূমিতে নিরাপদ নয়, তখন সেটি বিশ্বমানবতার ব্যর্থতা।

বিশ্ব এই দিনটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নিম্নলিখিত কারণে—

দৃষ্টি আকর্ষণ: বিশ্বের মানুষকে জানানো যে প্যালেস্টাইন এখনও সংকটে আছে।

জনমত সৃষ্টি: আন্তর্জাতিক জনমত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।

প্রতিরোধের নৈতিক শক্তি: নিপীড়িত জনগণকে জানানো যে তারা একা নয়।

শান্তির দাবি: টেকসই সমাধানের জন্য বিশ্বব্যাপী আহ্বান।

প্যালেস্টাইনের শিশুদের গল্প

যে পৃথিবীতে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার কথা, সেখানে প্যালেস্টাইনের শিশুরা শিখছে বোমা চিনতে।
যে বয়সে তারা খেলবে, গল্প শুনবে, সেখানে তারা শুনছে ড্রোনের শব্দ, শোকের চিৎকার।
যে বয়সে বই হাতে নেওয়া উচিত, সেখানে তারা হাতে নিচ্ছে পানির বোতল আর রুটি—কারণ বেঁচে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ।

শিশুরা কোনো রাজনীতি বোঝে না; তারা শুধু নিরাপত্তা চায়। কিন্তু তাদের জীবনে আনন্দের মতো শব্দগুলো এখন অনেক দূরের।

সহমর্মিতা দিবসে করণীয়

১. সচেতনতা বৃদ্ধি: প্যালেস্টাইনের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মানুষকে জানানো।

২. মানবিক সাহায্য জোরদার: বেসরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্যকর্মী, আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাকে সমর্থন করা।

৩. শান্তির পক্ষে অবস্থান: সহিংসতা, দখলদারিত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া।

৪. শিক্ষা ও আলোচনা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলোচনা-সেমিনার আয়োজন করা।

৫. মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা: ধর্ম, জাতি, রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে একজন মানুষের কষ্টকে মানুষের কষ্ট হিসেবে দেখা।

প্যালেস্টাইনের জনগণের অদম্য সংগ্রাম

দীর্ঘসময় ধরে দখলদারিত্ব ও যুদ্ধের মধ্যে থেকেও প্যালেস্টাইনের জনগণ লড়াই জমিয়ে রেখেছে। তারা হার মানেনি, মানেনি তাদের আত্মপরিচয়। তাদের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—

অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শিক্ষা

প্রতিরোধের শিক্ষা

অধিকার আদায়ের শিক্ষা

তাদের সংগ্রাম আমাদের শেখায়, সত্যিকার স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য লড়াই কখনো সহজ হয় না।

শান্তিই একমাত্র সমাধান

শান্তি ছাড়া এই সংকটের সমাধান নেই। অস্ত্র দিয়ে শান্তি আসে না; আসে সংলাপ, বোঝাপড়া, ন্যায়বিচার ও পরস্পরের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস সেই শান্তির পথকে প্রশস্ত করার একটি প্রতীক।

পরিশেষে,প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—বিশ্বের কোথাও একজন মানুষও যদি অন্যায়ের শিকার হয়, তবে আমরা কেউই সত্যিকারের নিরাপদ নই। সহমর্মিতা মানে শুধু সমর্থন নয়; এটি ন্যায়বিচারের প্রতি এক অঙ্গীকার। প্যালেস্টাইনের জনগণের কষ্ট আমাদের কষ্ট, তাদের লড়াই আমাদের লড়াই, তাদের স্বপ্ন আমাদের সবার স্বপ্ন—একটি পৃথিবী যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং শান্তির মধ্যে বেঁচে থাকবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।