তুষার বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ : ‘আমি লাশটার চিহ্ন দেখপার চাই। ওরে আমার কোলের তা-রে। লাশ ডা দাবি হরি। আর কোন অভিযোগ নাই। ওর মৃত্যু ওই জায়গা ছেলে। আল্লার মাল আল্লায় নেছে বাবা। অমি সরকারের কাছে লাশ ডা চাই। ও বিদেশে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গ্যছোলো। ওরে যাতি দেব না। বলছেলে সকল মানুষ যায়, অমি গেলি কি হবে? ওরে বাবারে তোমারে মৃত্যু টাইনে নেছেরে।’ 

আবেগভরা কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন লিবিয়া থেকে ইটালী যাওয়ার পথে নৌকা দুর্টনায় নিহত এনামুল শেখের মমমতাময়ী মা মনজেরা বেগম (৬০)।

গত ১৩ নভেম্বর রাতে লিবিয়ায় ভূমধ্যসাগর–সংলগ্ন আল-খুমস উপকূলে দুটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এতে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার দু’জন নিহত হন। তাঁরা হলেন উপজেলার ননিক্ষীর ইউনিয়নের পশ্চিম লওখন্ডা গ্রামের ইয়াকুব আলী শেখের ছেলে এনামুল শেখ (২৭) ও ওই গ্রামের সবেক মেম্বর জাহিদ শেখের ছেলে আনিস শেখ (২৫)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁদের মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারেন পরিবারের লোকজন।

এ ঘটনায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ওই ঘটনায় মুকসুদপুর উপজেলার আরও ৫ যুবকের নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- পশ্চিম লখন্ডা গ্রামের আওলাদ শেখের ছেলে ইব্রাহিম শেখ, একরাম মিনার ছেলে দুলাল মিনা, হায়দার মিনার ছেলে আশিক মিনা, খালেক মোল্লার ছেলে হাবিবুল্লাহ মোল্লা সোহেল ও গোহালা ইউনিয়নের গুনহর গ্রামের হাফিজ মিনার ছেলে নিয়াজ মীনা।

নিহত দুজনের পরিবার জানায়, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় একটিতে ছিলেন বাংলাদেশের ২৬ জন নাগরিক। ঘটনার পর চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী কয়েক দিন তথ্য সংগ্রহের পর তাঁরা নিশ্চিত হন এনামুল ও আনিস নিহত হয়েছেন।

শুক্রবার বিকেলে পশ্চিম লওখন্ডা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এনামুল শেখের বাড়ির উঠানে চেয়ার পেতে প্রতিবেশীরা বসে আছেন। এনামুলের বাবা ইয়াকুব, মা মনজেলা ও ভাই গিয়াস উদ্দিনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনরা। একপর্যায়ে নিজেরাই কেঁদে ফেলছেন। তাঁরা জানান, ইয়াকুব শেখের ৪ ছেলে। কোন মেয়ে নেই। এনামুল ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট।

কথোপকথনের এক পর্যায়ে শোকার্ত ইনামুলের বাবা বলেন, ছেলে বিএ পাশ করে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে এমএতে ভর্তি হয়েছিল। বাড়িতে বসে ফ্রিল্যান্সিএর কাজ করত। মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করত। আমরা তাকে বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেই। ছেলে বিয়ে না করে সমুদ্র পথে ইটালী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি তাকে বাধা দেই, কিন্তু আমার কথা শোনে নি। মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের দালাল ইমামুল মাতুব্বর আমাদের আত্মীয়। তাকে ২ লাখ টাকা দিয়ে ছিলাম। ইটালী পৌঁছানোর পর বাদবাকী টাকা দেওয়ার কথা ছিল। দালাল বলেছিল যাওয়ার সময় ধরা খেলে ছাড়িয়ে আনবে। কিন্তু সমুদ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় তিনি নেবেন না। জেনে বুঝেই আমার ছেলে এ পথে বেছে নেয়। এখানে দালালের কোন দোষ নেই। দোষ আমার কপালের। আমার ৪টি ছেলে বড় ছেলে গিয়াস উদ্দিন শেখ শারিরীক প্রতিবন্ধী গ্রামে মুদি দোকান করে। মেজ ছেলে তাজ উদ্দিন শেখ ইটালী প্রবাসী। সে সমুদ্র পথেই ইটালী গিয়েছিল। সেজ ছেলে জসিম উদ্দিন পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি করে। আমি নরসিংদী জেলার শিবপুরে কসমেটিক্সের ব্যবসা করাতাম। ৫ বছর আগে ছোট ছেলে ইনামুল ও অন্য ছেলেদের অনুরোধ ওই ব্যবসা ছেড়ে দেই। এখন গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করি।

ইয়াকুব আলী আরো জানান, গত ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ থেকে রওনা হন এনামুল। ১৩ নভেম্বর রাতে লিবিয়ার আল-খুমস উপকূল থেকে নৌকায় ওঠেন তাঁর ছেলে। কিছু দূর যেতেই নৌকাটিকে ধাওয়া করে কোস্টগার্ড। তাদের নৌকার মাঝ বরাবার অরেকটি নৌকা উঠে যায়। এনমুলদের নৌকাটি ডুবে যায় নৌকাটি। এতে এনামুল মারা গেছেন বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন।

নিহত এনামুল শেখের বড় ভাই শারিরীক প্রতিবন্ধী গিয়াস উদ্দিন শেখ বলেন, ‘আপনারা এতটুকু করেন যেন আমার ভাইকে দেশে আনতে পারি, দেশের মাটিতে কবর দিতে পারি। আমার ভাইয়ের কবরে আমরা যেন মাটি যেতে পারি।’

এনামুলের বাড়ির অদূরেই আনিস শেখের বাড়ি। তবে সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, ছোটবেলায় মাকে হারান আনিস। বাবা ও ৪ বোনের সংসার। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে আনিস বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স হিসেবে কর্মরত। তাঁদের সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে। নাম আনিসা।

ওই গ্রামের মেম্বর আলমগীর মোল্লা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মারা যাওয়ার পরই আমাদের হুঁশ ফেরে। অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সব জেনেশুনে আমরা সর্বস্ব খুইয়ে প্রিয় সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি। একটু ভালো থাকার আশায় এত টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠানো হয়। এখন সন্তানের লাশ ফিরবে কি না, সেই অনিশ্চয়তায় পরিবারগুলো। বিদেশ গমন বিষয়ে সচেতনতা, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং বিদেশে বৈধ অভিবাসন সুযোগ বাড়ানো ছাড়া এ মৃত্যুর মিছিল থামবে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, নিহত দুজন ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। লাশ ফেরাতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু তথ্য পাঠানো হয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান অধিদপ্তরে গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্টীপদ রায় বলেন, বৈধ অভিবাসন সুযোগ সরকার সৃষ্টি করেছে। সরকারিভাবে বৈধ পথেই ইটালী যাওয়া যায়। এ ব্যাপারে আমরা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করছি। তারপরও মানুষ অবৈধ পথে ইটালী যাচ্ছে। মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এটি দুঃখ জনক। আমার বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।

(টিবি/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০২৫)