ওয়াজেদুর রহমান কনক


আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের গুরুত্ব কেবল একটি তারিখে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানবসভ্যতার অমোঘ বিবর্তনীয় চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যে রেজোলিউশন ৪৭/৩ এর মাধ্যমে দিবসটি ঘোষণা করেছিল, তা কোনো আনুষ্ঠানিকতার ভাগ-বাঁটোয়ারা নয়; বরং মানবঅধিকার, মর্যাদা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির অনিবার্য সূত্রকে বৈশ্বিক নীতির কাঠামোয় স্থাপন করার প্রচেষ্টা। এই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিবন্ধিতা কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও বঞ্চনার সমষ্টিগত পরিণতি।

২০২৪ এবং ২০২৫ সালের থিমগুলো এই চিন্তার গভীরতাকে আরও প্রখরভাবে দৃশ্যমান করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্বের বিকাশ, তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ততাকে কেন্দ্র করে থিমগুলো এক নতুন সমাজতাত্ত্বিক উপলব্ধি তৈরি করেছে—যেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আর কোনো ‘উপকার’ বা ‘সহায়তা’ প্রাপ্যের অজুহাত নন; বরং উন্নয়ন, ন্যায়বিচার এবং সভ্যতার ভবিষ্যৎ গঠনে সক্রিয় ও সমান অংশীদার। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কেবল শারীরিকভাবে প্রবেশযোগ্য ভবন বা গণপরিবহন দিয়ে নির্মিত হয় না; তা নির্মিত হয় মানসিকতা, নীতি এবং সামাজিক কাঠামোর গভীরে নিহিত স্বীকৃতির সংস্কার দ্বারা।

বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আজও বহুমাত্রিক বৈষম্যের মুখোমুখি। তাদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সর্বাধিক, এবং অধিকাংশই কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত বা অনিরাপদ শ্রমবাজারে নিযুক্ত। সুযোগের অপ্রতুলতা, প্রযুক্তিগত সহায়তার সীমিত প্রাপ্তি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়বহুল কাঠামো—এসব উপাদান তাদের স্বনির্ভরতার পথে সুচিন্তিত বাধা তৈরি করে। সমাজে প্রচলিত ‘দয়া’প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ক্ষমতায়ন নয়, বরং পদ্ধতিগত হীনমন্যতা ও নির্ভরশীলতার চক্রকে দীর্ঘায়িত করে। এই চেতনা পরিবর্তন না হলে রাষ্ট্রীয় আইন বা আন্তর্জাতিক নীতিমালা কেবল কাগুজে প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়।

এই দিবস তাই মানবাধিকারের প্রশ্নকে নতুন করে সামনে আনে—প্রতিবন্ধিতা কি একটি চিকিৎসাগত সমস্যা, নাকি একটি সামাজিক নির্মাণ? আধুনিক মানবাধিকার তত্ত্ব বলে, প্রতিবন্ধিতা জন্মগত বা অর্জিত বৈশিষ্ট্য নয়, বরং সমাজের অপরিকল্পিত অবকাঠামো, নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল। যেদিন সমাজ তার কাঠামো এমনভাবে সাজাতে পারবে, যেখানে প্রতিবন্ধিতা কোনো সীমাবদ্ধতা নয় বরং মানববৈচিত্র্যের একটি স্বাভাবিক অংশ, সেদিনই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পূর্ণ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হবেন।

বাংলাদেশে সম্প্রতি (২০২১ সালের জাতীয় জরিপ অনুযায়ী) প্রায় ২.৮ % জনসংখ্যা — অর্থাৎ প্রায় ৩.৫–৪.৬ মিলিয়ন মানুষ — প্রতিবন্ধী হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। পুরনো কিছু গবেষণা উচ্চতর হিসেবে ৫–১২ % পর্যন্ত প্রতিবন্ধীতার প্রভাব দেখিয়েছে, যা দেখায় যে প্রকৃত হার সম্ভবত ৫–১৭ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে মাত্র ৬৫ % প্রাথমিক স্কুলে অন্তর্ভুক্ত — অর্থাৎ ৩৫ % পড়াশোনা থেকে বাদ। অন্যদিকে, মাধ্যমিক পর্যায়ে মাত্র ৩৫ % এবং মোট মিলিয়ে প্রায় ৬০ % প্রতিবন্ধী শিশুই কোনো প্রকৃত শিক্ষা পায় না।

২০২২ সালের শ্রমবাজার জরিপ (LFS 2022) অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ২২.৫৪ % শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন। পুরুষদের অংশগ্রহণ মাত্র ৩২.২২ %, আর নারীদের হলে মাত্র ১১.৩৪ %।

অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও সরকারি সহায়তা সীমিত। ২০২৪–২৫ সালের বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ০.৪৮ % — যা মোট বাজেটের অর্ধ-শতাংশও হয় না।

সামাজিক মনোভাব এবং স্টিগমা খুব প্রগাঢ়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজ প্রতিবন্ধীতাকে শাস্তি বা দৃষ্টিকোণভিত্তিক ‘অমঙ্গল’ হিসেবে দেখা চালিয়ে যায়, ফলে সমাজে প্রতিবেশী, কাজ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে অনেকেই বাদ পড়েন।

ইনফ্রাস্ট্রাকচার, পরিবহন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যবস্থাপকতা আজও প্রতিবন্ধী বান্ধব নয়। চ্যালেঞ্জ রয়েছে — যেমন, স্কুল, অফিস, যানবাহন ও জনপরিবহন এমনভাবে ডিজাইন করা হয়নি যাতে চাকা চেয়ার, বিশেষ সহায়ক যন্ত্র বা অন্যান্য সুবিধা প্রয়োজন হয় এমন ব্যক্তিরাও স্বচ্ছন্দে চলাচল বা অংশগ্রহণ করতে পারেন।

এ ছাড়া, সরকারি বরাদ্দ ও বাজেট অপ্রতুল। যখন বাজেটে মাত্র ০.৪৮ % বরাদ্দ দেখা যায়, তখন দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যাপক জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা চলানো সম্ভব হয় না। তবে ইতিমধ্যেই কিছু এনজিও, দাতা সংস্থা এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প কাজ শুরু করেছে — যদিও তা অস্থায়ী বা সীমিত পরিধির। এই উদ্যোগগুলো সাধারণত বিশেষ সহায়তা, সচেতনতা প্রচার, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বা শিক্ষা সংক্রান্ত।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, ডিজাইন ও জনপরিবহন, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা — সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য “accessibility (প্রবেশগম্যতা)” ও “inclusion (অন্তর্ভুক্তি)” নিশ্চিত করতে হবে। শুধু দান বা ভাতা নয়; স্বনির্ভরতা, দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
এই উদ্দেশ্য তাই নাগরিকত্বের একটি নতুন সংজ্ঞা প্রস্তাব করে—যেখানে কেবল জন্মসূত্রে নয়, বরং সুযোগ, কার্যক্ষমতা এবং সামাজিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পূর্ণতা পায়।

প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের আধুনিক দর্শন বলে—সমান সুযোগ যথেষ্ট নয়; ‘ন্যায়’ (equity) দরকার। সমান সুযোগ মানে সকলকে একই দেওয়া, অথচ ন্যায় মানে যারা পিছিয়ে আছে তাদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আলাদা, উপযোগী, সক্ষমতাভিত্তিক সুযোগ তৈরি করা। যেমন, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যদি স্কুলে যেতে চান, তবে তাকে কল্যাণ দিয়ে সাহায্য করা নয়; স্কুলে র্যাম্প, উপযোগী টয়লেট, উপযুক্ত পরিবহন এবং সহায়ক শিক্ষাবিন্যাস নিশ্চিত করাই ন্যায়।

পরিশেষে, প্রতিবন্ধী অধিকার বিষয়ক এই আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল নতুন আইন, নতুন প্রতিষ্ঠান বা বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়; বরং মানুষের মূল্যবোধ, উন্নয়ন দর্শন ও কাঠামোগত ক্ষমতার ভারসাম্যকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করা। একটি সভ্য সমাজ পরিমাপ হয়—তার রাস্তা, সেতু বা আকাশচুম্বী ভবন দিয়ে নয়, বরং সে কতটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে তাদের জন্য—যাদেরকে সমাজ একসময় অদৃশ্য ভেবেছিল।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।