ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : দেশের উত্তরের অনুন্নত ও সুবিধাবঞ্চিত সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও। মূলত কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলে শিল্পায়ন গড়ে না ওঠায় অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে পিছিয়ে পড়েছে এ জেলার মানুষ। জেলার ৫ টি উপজেলার ৪ টিই সীমান্তঘেষা হওয়ায় এ অঞ্চলের শিশুরা রয়ে যায় সুবিধাবঞ্চিত হয়ে। আর তাই প্রতিভা বিকাশে পিছিয়ে থাকে এসব শিশুরা।

ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলা, সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের দরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের প্রতিভা বিকাশে নিভৃতে কাজ করছে গেম চেঞ্জার প্রকল্প। সংগীত-নৃত্য এবং খেলাধুলা সৃজনশীল এসব গুণাবলীকে শাণিত ও বিকশিত করতে সকল প্রকার সহযোগিতা করে আসছে ইএসডিও’র এ প্রজেক্ট।

উপজেলার হতদরিদ্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের সৃজনশীল ও মননশীলতায় খেলাধুলা এবং সংগীত-নৃত্যে পারদর্শী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেসব শিশুদের দেয়া হচ্ছে সকল প্রকার সহযোগিতা। ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের বাস্তবায়নে উপজেলার তিনটি শিক্ষা কেন্দ্রে সঙ্গীত ও নৃত্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যেখানে রয়েছে প্রায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। এছাড়াও অনুশীলনের জন্য দেয়া হয়েছে হারমোনিয়াম, তবলা, সাউন্ড বক্স, নাচের জন্য গহনা এবং সঙ্গীত ও নৃত্যের উপযুক্ত প্রশিক্ষক। ফলে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে এ সকল ক্ষুদে শিশু শিল্পীরা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা নতুন কুঁড়িতে নানা ক্যাটাগরিতে যেমন- নৃত্যে স্থান পেয়েছে ৭ জন, সঙ্গীতে স্থান পেয়েছে ৪ জন এবং আবৃত্তিতে ১ জন।

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন এবং অনূর্ধ্ব ১৭ দলকে দেয়া হচ্ছে যাতায়াতের জন্য বাই-সাইকেল, ফুটবল, খেলার বুট, জার্সি খেলার সামগ্রীসহ সকল প্রকার লজিস্টিক সহযোগিতা। তাদের শারীরিক ইমিউনিটি ধরে রাখতে প্রতিদিন অনুশীলনের পর দেয়া হয় পুষ্টিকর খাবার। এছাড়াও ১০ জন হত দরিদ্র পরিবারের খেলোয়াড়দের ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। এ সকল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে খুশি উপজেলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুরা।
ফলশ্রুতিতে, ক্রীড়াক্ষেত্রে ঠাকুরগাঁও জেলার হয়ে রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমি জেএফএ কাপ রংপুর বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন এবং জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। একাডেমির ২ জন খেলোয়াড় অনূর্ধ-১৭ জাতীয় দলে এবং ১ জন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে। এছাড়াও ৭ জন খেলোয়াড় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)-তে সুযোগ পেয়েছে।

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড় জবা রায় বলেন, দূর থেকে মাঠে অনুশীলনে আসতে সমস্যা হতো। এডুকোর সহযোগিতায় বাই-সাইকেল ও খেলার সামগ্রী পেয়ে অনুশীলন অনেকটাই সহজ হয়েছে। আমরা দেশকে আরো ভালো খেলা উপহার দিতে পারব বলে আশা করছি।

সঙ্গীতের শিক্ষার্থী শ্রেয়া রায়, মিমি বসাক জানায়, আমাদের গানের টিচার খুব যতœ নিয়ে আমাদের গান শেখায়। এছাড়া অনুশীলনের জন্য বাদ্যযন্ত্র পেয়েছি যা আমাদের অনেক উপকারে আসছে।

নাচের শিক্ষার্থী জান্নাতুন ফেরদৌস মনিষা বলে, ‘নাচের আগ্রহ থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও প্রশিক্ষণের অভাবে তা করতে পারিনি। গেম চেঞ্জার প্রকল্প বিনামূল্যে আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং নতুন কুঁড়ি ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। আমার মত অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা এখানেই শিখে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে।

জেলা কালচারাল অফিসার আলমগীর কবির বলেন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতা রয়েছে। যার কারনে তারা তৃণমূল গ্রামীন মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় না। প্রতিটি মানুষের মাঝে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। ইএসডিও এই প্রতিভাকে বিকশিত করতে কাজ করছে, যা প্রশংসার দাবিদার । এই ধরনের প্রজেক্ট তৃণমূলের সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা পাচ্ছে,যা খেলাধুলা ও সংস্কৃতিক অঙ্গনে অনন্য অবদান রাখবে বলে আমি আশা করি।

ইএসডিও'র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহাম্মদ শহিদুজ্জামান বলেন, সুযোগ এবং অভিজ্ঞতার অভাবে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের প্রতিভাবান শিশুরা ঝরে পড়ে তাদের প্রতিভা দেখানোর ক্ষেত্রে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্যই ইউএসডিও এবং এডুকোর যৌথ উদ্যোগে রাণিসংকৈল উপজেলায় গেম চেঞ্জার প্রজেক্টের মাধ্যমে শতাধিক শিশুকে ক্রিড়া এবং সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এর সুফল আমরা পেয়েছি। এ বাচ্চাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খেলোয়াড় বিভাগীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। একইভাবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন কুড়িতে এসব শিশুদের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে ইয়েসকার্ড পেয়েছে। আমাদের তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা প্রতিভাবান শিশুদের যদি যথাযত ভাবে নার্সিং করা যায় তাহলে তারা এ দেশকে বদলে ফেলতে পারবে।

উল্লেখ্য, রাঙ্গা টুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখছে। তাই এ ধরনের উদ্যোগ আরো বেশি নেয়া হলে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েরাও সৃজনশীল ও উন্নদ জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। আমাদের শিশুরা পাবে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ এমনটাই বলছে সংশ্লিষ্ট ও বিশিষ্টজনেরা।

(এফআর/এসপি/ডিসেম্বর ০২, ২০২৫)