ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস—একটি দিন যা প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা ও তা সমাধানের জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। বিশেষ করে শীতকাল যখন আমাদের দেশে নীরবে উপস্থিত হয়, তখন প্রতিটি প্রতিবন্ধীর জন্য পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও কঠিন, কখনো কখনো ঝুঁকিপূর্ণও।

শীত শুধু ঠাণ্ডার কাঁপুনিই নয়—এটি প্রতিবন্ধী মানুষের দৈনন্দিন জীবন, চলাফেরা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসিক সুস্থতার ওপর বহুমাত্রিক চাপ সৃষ্টি করে। এই বাস্তবতা বিবেচনা করেই শীতকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ চাহিদা ও সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের শীতকালীন চ্যালেঞ্জ

যারা হুইলচেয়ার, ক্রাচ বা অন্য সহায়ক যন্ত্র ব্যবহার করেন, শীতকাল তাদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। ভেজা ও পিচ্ছিল রাস্তা হুইলচেয়ারের চাকায় কাদা জমিয়ে চলাচল কঠিন করে তোলে। গ্রামীণ কাঁচা রাস্তায় স্লিপ হয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা বাড়ে এবং শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যায়। মসশরীরের তাপমাত্রা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না থাকায় স্নায়ুজনিত প্রতিবন্ধীরা সহজেই শীতজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হন। যাদের পা বা অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোতে সংবেদনশীলতা কম, তারা বুঝতেই পারেন না কখন শরীরের অংশ জমে যাচ্ছে, ফলে হাইপোথার্মিয়া বা ঠাণ্ডাজনিত ক্ষতি ঘটে।

দৃষ্টিহীনদের শীতের বাড়তি ঝুঁকি

অন্ধ বা দৃষ্টিহীন ব্যক্তিদের জন্য শীতকাল বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং।

কুয়াশায় শব্দের দিক নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে তাদের হোয়াইট-কেন বা গাইড কুকুর ঠিকমতো পথ চিনতে পারে না।

ভেজা মাটি ও বরফের আস্তরণ চলাফেরা আরও বিপজ্জনক করে তোলে।

শীতের কারণে সহায়তাকারীর সংখ্যা কমে গেলে তাদের বাইরে চলাফেরা কার্যত অসম্ভব হয়ে যায়।

অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরো ঋতু ঘরবন্দি হয়ে পড়েন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের অতিরিক্ত সমস্যা

অনেকেই মনে করেন শীত তাদের তেমন সমস্যায় ফেলে না, কিন্তু বাস্তবে—

ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে কানে জমাট বাঁধা, কান ব্যথা বা সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়।

মাস্ক পরার ফলে ঠোঁট পড়া কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে তাদের যোগাযোগ ব্যাহত হয়।

বাইরে ঠাণ্ডা বাতাসে ইশারা ভাষার ব্যবহার করাতেও অস্বস্তি হয়।

মানসিক স্বাস্থ্য: অদৃশ্য কিন্তু বড় সমস্যা

শীত যতটা শারীরিকভাবে বিপজ্জনক, মানসিকভাবেও ততটা কঠিন।

দিনের আলো কমে যাওয়ায় সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিসঅর্ডার (SAD) দেখা দিতে পারে, যা বিষণ্নতা বাড়ায়।

প্রতিবন্ধীরা অনেকক্ষেত্রে ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়েন, ফলে তাদের সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

পরিবার বা পরিচিতদের অতিরিক্ত সতর্কতা কখনো কখনো তাদের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে দেয়।

এই মানসিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে বড় সমস্যা তৈরি করে, যেমন উদ্বেগ, হতাশা ও আত্মসম্মানহানী।

স্বাস্থ্যসেবা: শীতকালে সবচেয়ে কঠিন অংশ

শীত বাড়লে গ্রামীণ অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অচল হয়ে পড়ে।

কুয়াশায় অ্যাম্বুলেন্স দেরি করে পৌঁছায়।

রাস্তায় কাদা থাকায় প্রতিবন্ধীদের হাসপাতালে পৌঁছানো কষ্টকর।

শীতজনিত রোগ যেমন সর্দি, ফ্লু, হাঁপানি, নিউমোনিয়া—প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

অনেক পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে ওষুধ, গরম পোশাক বা পুষ্টিকর খাবার কেনা সম্ভব হয় না, ফলে অসুস্থতা আরও বাড়ে।

অর্থনৈতিক ও পুষ্টিগত চ্যালেঞ্জ

শীতকালে অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজন হয়—কিন্তু প্রতিবন্ধী পরিবারের অনেকেই নিম্নআয়ের হওয়ায়: গরম পোশাক, কম্বল, থার্মাল জুতা, হিটার,—এসব সহজে কিনতে পারেন না। ফলে শরীরে তাপমাত্রা ধরে রাখা কঠিন হয়। অপুষ্টি ও ঠাণ্ডা মিলে তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে, যা দ্রুত রোগ সংক্রমণ ঘটায়।

সামাজিক বৈষম্য ও অবহেলা

শীতকালে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক বৈষম্য কিছুটা বেশি প্রকট হয়।

অনেকে মনে করেন শীতে তাদের বাইরে বের হওয়া উচিত নয়—এটি ভুল ধারণা।

স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধী সুবিধা কম থাকায় তারা অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হন।

বাজার, অফিস বা গণপরিবহনে প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ না থাকায় তাদের সামাজিক জীবন সংকুচিত হয়।

মানুষের আচরণও ভূমিকা রাখে—অনেকে সহানুভূতি দেখালেও কেউ কেউ প্রতিবন্ধীদের অপ্রয়োজনীয় বোঝা হিসেবে দেখে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের অভাব

শীতপ্রতিরোধী সহায়ক যন্ত্রপাতি যেমন:

হুইলচেয়ার কভার

তাপ সংরক্ষণী গ্লাভস

অ্যান্টি-স্লিপ চাকা

ব্যাটারি চালিত হিটিং প্যাড
—এসব অত্যন্ত দরকারি, কিন্তু দেশে এসব সরঞ্জাম খুব সীমিত, আর দামও বেশি।

সমাধানের দিকনির্দেশনা

শীতকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপদ রাখতে সরকার, সমাজ ও পরিবার—সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

১. সরকারি উদ্যোগ

পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে রাস্তায় কাদা ও বরফ পরিষ্কার রাখতে হবে।

জনপরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী-বান্ধব র‌্যাম্প ও রেলিং বাধ্যতামূলক করা।

গ্রামে মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ও শীতকালীন বিশেষ মেডিকেল ক্যাম্প চালু করা।

সুলভ মূল্যে গরম পোশাক বিতরণ কার্যক্রম বিস্তৃত করা।

২. সামাজিক পদক্ষেপ

প্রতিবন্ধীদের চলাচলে স্বেচ্ছাসেবীদের যুক্ত করা।

স্কুল, অফিস, বাজার—সব জায়গায় প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।

সাধারণ মানুষকে শেখানো—কীভাবে হুইলচেয়ার ঠেলতে হয়, কিভাবে দৃষ্টিহীনকে রাস্তা পার করাতে হয়।

৩. পরিবারের ভূমিকা

ঘর উষ্ণ রাখা, গরম পোশাক নিশ্চিত করা।

প্রয়োজন ছাড়া তাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ না করে নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা।

মানসিক সমর্থন দেওয়া ও কথা বলা—এগুলোই শীতের একাকীত্ব কমাতে সাহায্য করে।

৪. প্রযুক্তির ব্যবহার

পুনর্ব্যবহারযোগ্য হিটিং প্যাড

শীতপ্রতিরোধী হুইলচেয়ার অ্যাক্সেসরি

সোলার বা ব্যাটারি চালিত পোর্টেবল হিটার

মোবাইল হেলথ অ্যাপ ও টেলিমেডিসিন

এসব প্রযুক্তি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনমানকে আরও উন্নত করতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজেরই অংশ, এবং তাদের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শীতকাল তাদের জন্য যে অসুবিধা সৃষ্টি করে, তা কমাতে আমাদের সচেতনতা, সহমর্মিতা ও কার্যকরী পদক্ষেপ একসাথে কাজ করতে পারে।

যখন আমরা গরম কাপড় জড়িয়ে আরাম করি, তখন মনে রাখা উচিত—অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ এখনো ঠাণ্ডার সঙ্গে লড়াই করছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবিকতা।

একটি উষ্ণ, সমানাধিকারভিত্তিক ও নিরাপদ সমাজ গড়তে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে—আজই, এখন

লেখক: কলাম লেখক ও প্রবন্ধকার, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।