ইমা এলিস, নিউ ইয়র্ক : গত বসন্তে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস) প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের এক বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে, যেখানে অভিবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হয় সরকারের অ্যাপ ‘সিবিপি হোম’ ব্যবহার করে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ ছাড়লে তারা একটি ফ্রি বিমান টিকিট এবং ১ হাজার ডলারের নগদ বোনাস পেতে পারেন। ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির অফারের মতো শোনালেও এর ভেতরে ছিল এক অন্ধকার বার্তা 'নিজে দেশ ছাড়ুন।'

প্রায় নয় মাস পর, ডিএইচএস–এর দুই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩৫হাজার মানুষ সিবিপি হোম ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়েছে। বিজ্ঞাপনের খরচ, বিমান ভাড়া এবং নগদ অর্থ মিলিয়ে প্রতি 'স্বেচ্ছা নির্বাসন'–এর গড় ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ ডলারের মতো।

ডিএইচএস মুখপাত্র ট্রিসিয়া ম্যাকলাফলিন জানিয়েছেন, 'প্রজেক্ট হোমকামিং'নামে এই কর্মসূচি অবৈধ অভিবাসীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার “সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি” তৈরি করেছে। তবে তিনি প্রতি স্বেচ্ছা নির্বাসনের ব্যয় কত তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। বিভাগটির হিসাব অনুযায়ী, কাউকে গ্রেপ্তার, আটক ও বিতাড়ন করতে আইসিই'র খরচ হয় মাথাপিছু ১৭ হাজার ডলারের বেশি।

এই ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন প্রচারের লক্ষ্য ছিল শুধু অভিবাসীরা নয় রাষ্ট্রপতির মূল রাজনৈতিক সমর্থকেরাও। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের কাছে দুই ন্যাশনাল গার্ড সদস্যকে গুলি করার ঘটনায় এক আফগান নাগরিককে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন তিনি 'তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের' অভিবাসন স্থায়ীভাবে স্থগিত করতে চান এবং 'রিভার্স মাইগ্রেশন' অর্থাৎ 'ওদের বের করে দাও'-এর আহ্বান জানান। হোয়াইট হাউস বছরে ১০ লাখ নিষ্কাশনের লক্ষ্য ধরেছে, কিন্তু চলতি বছরের ডেটা অনুযায়ী ট্রাম্পের প্রথম বছরে আইসিই প্রায় ৪ লাখ বিতাড়ন করতে সক্ষম হবে। যদিও এটা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ, তবু ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতির তুলনায় কম।

আগে ডিএইচএস–এর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি স্ট্যাটিস্টিকস অফিস মাসিকভাবে গ্রেপ্তার, বিতাড়নসহ বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করত। কিন্তু জানুয়ারির পর থেকে আর কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি; প্রশাসন যেসব সংখ্যা জানায় সেগুলো সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়।
ডিএইচএস সচিব ক্রিস্টি নোম আইসিই এজেন্টদের গ্রেপ্তার কোটা নির্ধারণ করে বিতাড়নের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কঠোর রাস্তার অভিবাসন দমনের দৃশ্য ব্যবহার করে ভয় তৈরি ও মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছা নির্বাসনকে দেখানো হচ্ছে আইসিই–এর কঠোর অভিযানের তুলনায় “মানবিক বিকল্প” হিসেবে—যেখানে মানুষ নিজের শর্তে দেশে ফিরতে পারে।

ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নোমের টিম জরুরি ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন প্রচারের চুক্তি দেয়, প্রতিযোগিতামূলক বিডিং প্রক্রিয়া এড়িয়ে। এ নিয়ে চারজন সিনেটর, যার মধ্যে আছেন সিনেট হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির ডেমোক্র্যাট গ্যারি পিটার্স, ডিএইচএস ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছে তদন্ত চেয়েছেন। প্রোপাবলিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঠিকাদারদের একজন ‘স্ট্র্যাটেজি গ্রুপ’-ডিএইচএস মুখপাত্র ম্যাকলাফলিনের স্বামীর কোম্পানি, যা নোম এবং ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কোরি লিউয়ানডস্কির জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করেছে।

ডিএইচএস কর্মকর্তারা কোনও অনিয়ম অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলো সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্প্যানিশ ভাষার ক্রীড়া সম্প্রচারে এখনও প্রচারিত হচ্ছে। এক বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়: 'যদি আইসিই আপনাকে খুঁজে পায়'-এবং সঙ্গে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বিমানে তোলা হচ্ছে। এরপর দেখানো হয়: 'যদি আপনি স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়েন' এবং হাসিমুখে যাত্রীরা বিমানে উঠছে।

তবে ব্যয়বহুল প্রচারণা মানুষকে সিবিপি হোম ব্যবহার করতে তেমন উৎসাহিত করতে পারেনি। ডিএইচএস–এর নিজের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর যারা দেশ ছেড়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র প্রতি ৫০ জনে ১ জন অ্যাপটি ব্যবহার করেছে। বাকিরা নীরবে দেশ ছাড়ছে টাকা বা ফ্রি ফ্লাইট ছাড়াই।

তবুও নোম দাবি করছেন তারা হোয়াইট হাউসের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন ১.৬ মিলিয়ন মানুষ স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়েছে। যদি সত্যি হয়, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি–জন্ম নাগরিকদের জনসংখ্যায় রেকর্ড সর্বোচ্চ পতন হবে যার প্রভাব খাদ্যদ্রব্যের দাম, ভাড়া, মজুরি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকে পড়তে পারে।

ডিএইচএস-এর এই দাবি ‘সেন্টার ফর ইমিগ্রেশন স্টাডিজ’-এর এক গবেষণার উপর ভিত্তি করে। গবেষক স্টিভেন কামারোটার মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিদেশি–জন্ম জনসংখ্যা কমেছে ২২ লাখ যার তিন-চতুর্থাংশই নাকি 'স্বেচ্ছা নির্বাসন।'

কিন্তু অর্থনীতিবিদদের অনেকে এই সংখ্যাকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করছেন। পিটারসন ইনস্টিটিউটের জেড কোলকো বলছেন, এত বড় জনসংখ্যা পতন হলে শ্রমবাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার কথা—যা কোনো অর্থনৈতিক সূচকে প্রতিফলিত হয়নি।

বাসাভাড়াও মূলত দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে কমেছে, যেখানে অতিরিক্ত আবাসন নির্মাণ হয়েছে—স্বেচ্ছা নির্বাসনের প্রভাব খুব স্পষ্ট নয়।

অনেকে আশঙ্কা করছেন শ্রমিক সংকটে নির্মাণ ও সার্ভিস সেক্টরের পণ্যের দাম বাড়তে পারে। ডিএইচএস দাবি করছে মজুরি বাড়ছে—কিন্তু শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য তা দেখায় না।
ডিএইচএস বছর শেষে দেশত্যাগের সংখ্যা বাড়াতে ছুটির মৌসুমে সিবিপি হোম ব্যবহারের প্রচারণা জোরদার করেছে। এক বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে-'এই ছুটির মৌসুমে নিজেকে উপহার দিন-বাড়ি ফেরার।' আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে পেরি কোমোর গান: হোম ফর দ্য হলিডেজ।

(আইএ/এসপি/ডিসেম্বর ০৩, ২০২৫)