রহিম আব্দুর রহিম


'বাংলাদেশ' নামটির উচ্চারণের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংবিধানের যে যোগসূত্র তা উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। এই দেশটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি, শাসন-শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে একনদী রক্তের বিনিময়ে লাখো শহীদের তাজা প্রাণের বদৌলতে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশ সৃষ্টির নেপথ্যের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে  সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনী ঘিরে। যেসমস্ত কাহিনী  আজ ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।যা যুগে যুগে বিশ্বের বুকে আমাদেরকে বীরের জাতি হিসেবে  মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে এবং দেবে।যে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, গ্রন্থিত হয়েছে কাব্যকাহিনী, বিনির্মাণ হচ্ছে দেশমাতৃকা, সেই ইতিহাস, কি ভুলে যাবার!কখনই না।

সালাউদ্দিন টগবগে যুবক, সবেমাত্র দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র, দেশ মাতৃকার টানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান ভারতে। পানিঘাট প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এই মহাবীর সালাউদ্দিন। রংপুরের পীরগঞ্জের জাবরহাট ক্যাম্পে অবস্থান করছেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা।

সেদিন ছিলো১৯৭১ সালের ১০নভেম্বর, শুক্রবার। চলছে মাহে রমজান। মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিনের কাছে খবর আসে পাকিস্তানিরা তাঁর বাবাকে গ্রেফতার করেছে (সংবাদটি ছিলো পাতানো একটি ফাঁদ) । এই সংবাদ শোনার পর সে গভীর রাতেই ১১ মাইল পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছান। সালাউদ্দিনের বাড়ি আসার খবরটি রাজকাররা দ্রুত পৌঁছে দেয় পাকবাহিনীদের ক্যাম্পে। সালাউদ্দিন বাড়ি প্রবেশ করে দেখতে পান তাঁর বাবা সুস্থ আছেন।এতে তিনি কিছুটা বিপদ আঁচ করেন।

সিদ্ধান্ত নেন, রাতটা কোন রকম কাটিয়েই পরদিন সকালেই বেরিয়ে যাবেন।কিন্তু না, তাঁর মায়ের‌ পীড়ন কিছুটা সময় মায়ের সাথে থাকবার।এরমাঝেই রাজাকারদের সহযোগিতায় সালাহউদ্দিনের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিন পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ধরা পড়ে যান হানাদার বাহিনীর হাতে। বাড়ি থেকে তাঁকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে(বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তর, ঠাকুরগাঁও)। সালাউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর মা, নিজের জীবনের বিনিময়ে সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চান। কিন্তু পাকিস্তানীরা ছিলো অনড়।

একপর্যায়ে সালাউদ্দিনের মা ঘর থেকে কোরআন শরীফ নিয়ে এসে পাক ক্যাপ্টেনের হাতে দিয়ে বলেছিলো ‘রমজান মাস। তুমি আমার ছেলেকে মারবা না, শুধু এই কথাটুকু বলে যাও।' তখন ওই ক্যাপ্টেন কোরআন ছুঁয়ে বলেছিলো, ‘উসকো নেহি মারুঙ্গা। ’সালাউদ্দিনকে আটকের পর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের টর্চার সেলে নেয়া হয়। এরপর শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য জানতে চেয়ে বলা হয়, যদি তিনি স্বীকার করেন তবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সালাউদ্দিন। এরপর হানাদার বাহিনী তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখালেও তিনি অটল থাকেন। শুরু হয় তাঁর উপর চরম পৈশাচিক নির্যাতন। জীবন্ত সালাউদ্দিনের চোখের মণিতে বড়শি বিঁধিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে তাঁর এক হাতের আঙ্গুল কেটে নেয়া হয়। অন্য আঙ্গুলগুলোতে পেরেক ঢুকিয়ে তথ্য আদায়ের পৈশাচিক নির্যাতন চলে।এতেও ক্ষান্ত হয়নি। হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে এই দেশপ্রেমিককে ঝুলিয়ে রাখে ।কিন্তু না, সালাউদ্দিন মরতে রাজী, তবু তথ্য দিতে নয়।

উল্লেখ, পাকিস্তানীরা কয়েকদিন আগে সার্কাস পার্টি থেকে দুটি বাঘ এবং দুটি শাবক জব্দ করে ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে রেখেছিল।

শেষ পর্যন্ত তাঁকে এই বাঘের খাঁচায় ছুঁড়ে মৃত্যুদন্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা।যে কথা সেই কাজ। জীবিত সালাউদ্দিনকে কিভাবে বাঘে খাবে, তা জন-মানুষকে দেখার জন্য গণহত্যাকারীরা জিপে করে সমস্ত ঠাকুরগাঁও শহরে মাইকিং করে দেয়। ১২ নভেম্বর, ১১টার দিকে পাকিস্তানী মেজর মাহমুদ হাসান বেগ বেরিয়ে এসে সালাহউদ্দিনকে বলে, তোমার সামনে এখন দুটি পথ খোলা। হয় তোমার সহযোদ্ধাদের সমস্ত গোপন খবর আমাদের কাছে দিবে, নয়তো ক্ষুধার্ত বাঘের খাবারে পরিনত হবে। কিন্তু তাতেও দমে যাননি সালাউদ্দিন।‌ একপর্যায়ে সালাউদ্দিনকে বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দিয়ে খাঁচা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এসময় খাঁচায় থাকা একটি বাঘ সালাউদ্দিনের বুক ও মুখে থাবা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে খেয়ে ফেলে। মুহূর্তে দুটো বাঘের ধারালো থাবায় আর কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত সালাহউদ্দিন পড়ে থাকেন মাটিতে।‌মহান মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিনের এমন মর্মান্তিক পরিণতি দেখে উল্লাসে মেতে উঠে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা। সেই অকুতোভয় সৈনিকদের আত্মত্যাগই আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং সকল গর্ব ও অহংকারের প্রাণকেন্দ্র আমার- তোমার এবং সবার প্রিয় মহান স্বাধীন বাংলাদেশ।

লেখক : নাট্যকার ও গবেষক।