ফেসবুক পোস্ট ডিলেটকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরা সরকারি বালক বিদ্যালয়ে সংঘর্ষ, আহত ৩
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সরকারি বালক বিদ্যালয়-একসময় জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত পেলেও এখন এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান তলানীতে। চার দফা দাবিতে চলমান শিক্ষক আন্দোলন, প্রশাসনিক অচলাবস্থা ও ছাত্রদের বিভক্তি পুরো পরিবেশকে জটিল করে তুলেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ফেসবুকে পোস্ট ডিলেট না করাকে কেন্দ্র করে জুনিয়র- সিনিয়র দুই গ্রুপের সহিংসতায় রক্তাক্ত হয় চার শিক্ষার্থী। এর আগে মঙ্গলবারের সংঘর্ষে সাংবাদিক হেনস্তা ও পরীক্ষা স্থগিত-সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে থাকে।
এই অস্থিরতার নেপথ্যে যে প্রাইভেট পড়ানো আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে- অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন কিছু তথ্য।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে পরীক্ষা শেষে ক্যাম্পাসে দাঁড়াতেই দেখা দেয় উত্তেজনা। মঙ্গলবারের সংঘর্ষের ভিডিও-ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করায় ক্ষুব্ধ ছিল দশম শ্রেণীর ছাত্র প্রভাববিস্তারকারী জিসানের অনুসারীরা। তারা ঘোষণা দিয়েছিল- 'ফেসবুকের সব ভিডিও-পোস্ট ডিলেট করতে হবে'। কিন্তু কিছু ছাত্র পোস্ট ডিলেট করলেও কয়েকজনের ফেসবুক ওয়ালে ভিডিও থেকে যায়। এ নিয়েই হাতাহাতি, শেষে রক্তাক্ত সংঘর্ষে রূপ নেয়।
আহত শিক্ষার্থীরা হলেন- অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ইরফান আজম খান, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র বাদশাহ শিহাবুল, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আরেফিন চৌধুরী। লোহার স্কেল, কলম এবং ইট দিয়ে চারজনকে মারধর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, 'মারধর ছিল উদ্দেশ্যমূলক। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে ওই ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিশোধ হিসেবে অপর গ্রুপ দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- 'ভাই ভাই মোটরসাইকেল শো রুমে' হামলা চালানোর খবর জানা গেছে। যার ভিডিও চিত্র ইতোমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
এর আগে চার দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের কর্মবিরতির প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষার্থীরা দুই দলে বিভক্ত হয়। এ নিয়ে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা শুরু হয়, যা দ্রুত হাতাহাতি-কিলঘুষিতে রূপ নেয়। এসময় বিএনপি নেতা আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রোহিত আহত হয়।
সরেজমিনে জানা যায়- আন্দোলনকারী শিক্ষকরা মঙ্গলবার বিদ্যালয়ের পরীক্ষার কার্যক্রমে বাধা দেয়, ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়নি এবং শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর উত্তেজিত সিনিয়র গ্রুপের হামলার চেষ্টা হয়।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বরাতে জানা গেছে- জিসান গ্রুপের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষক- মাহির গ্রুপের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে ভিন্নমতের আরেক শিক্ষক গোষ্ঠী। এই দুই গ্রুপেই আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এছাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কিছু শিক্ষক দৃষ্টি বাঁকা করে রেখেছেন।
জানা গেছে- যে শিক্ষকেরা চার দফা দাবি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তারাই বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।
এ বিষয়ে একজন অভিভাবক বলেন- সিনিয়রদের নির্দেশ না মানায় জুনিয়রদের মেরেছে- এ কথাই শুনছি। যারা মেরেছে তারা সবাই পলাতক, তাদের বাবা-মায়ের ফোন বন্ধ।
অন্য একজন অভিভাবক বলেন- আমার সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। বড়রা নাকি বলেছে, শেষ পরীক্ষার দিন ৭ ডিসেম্বর জুনিয়রদের মজা দেখানো হবে। আমরা আতঙ্কে আছি।
প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম টুকু বলেন- ছাত্রদের প্রতিটি ঘটনাই আমি ডিসি স্যারকে জানিয়েছি। ২ ডিসেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট এসে পরীক্ষা নিতে চাইলেও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। যেসব শিক্ষক ছাত্রদের পরীক্ষা দিতে দেয়নি, ম্যাজিস্ট্রেট সিসিটিভি দেখে ১০ জনের তালিকা নিজ হাতে করেছেন। এখন সেই শিক্ষকদের পক্ষেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে।
তিনি আরও বলেন- কে বা কারা ছাত্রদের মধ্যে মারামারি বাধিয়ে ফায়দা লুটছে- আমি বলতে পারছি না। তবে পুরো ঘটনায় সুপরিকল্পিত একটি চক্রান্ত রয়েছে।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মিজ আফরোজা আখতার বলেন- ঘটনা জানার পরপরই পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পেরেছি। তবে বড় ধরনের কোন ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সজাগ থাকতে হবে। আর আগেই জানিয়েছি যেকোন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা চালিয়ে নিতে হবে। আগামী ৭ তারিখে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ থাকবে যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। তবে যারা আন্দোলনকারী তাদের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক চিহ্নিত ১০ জন শিক্ষকের বিষয়ে জেলা প্রশাসক কিছুই বলেন নি।
অভিভাবকদের দাবি- পরীক্ষা, স্কুলে ক্লাস এবং নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা মনে করেন- শিক্ষক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রশাসনিক অচলাবস্থা পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত করেছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষা কেন্দ্রে থাকলেও পরীক্ষা না হওয়া স্কুল ব্যবস্থাপনার গুরুতর ব্যর্থতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উত্তেজনা বাড়িয়েছে, ফেসবুক পোস্ট ডিলেট করার নামে ছাত্রদের ওপর চাপ প্রয়োগ যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ডিজিটাল বুলিংয়ের ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। যা স্কুলের বাইরে হামলা- অপরাধ প্রবণতা বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এছাড়াও অভিভাবক-ছাত্র- শিক্ষকের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। যা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে।
সাতক্ষীরা সরকারি বালক বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি স্কুলের সংকট নয়-এটি শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকট-ষড়যন্ত্রের চিত্র। শিক্ষক আন্দোলন, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের অতিরিক্ত প্রভাব, ফেসবুক-রাজনীতি, জুনিয়র-সিনিয়র বিভাজন-সব মিলিয়ে একটি সুশৃঙ্খল শিক্ষা পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই- শিক্ষক- প্রশাসন- জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শক্ত হাতে দমন করা। না হলে ছাত্রদের মধ্যে যে কোনো সময় আরও বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে।
(আরকে/এএস/ডিসেম্বর ০৪, ২০২৫)
