হাবিবুর রহমান, ঝিনাইদহ : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহের হানাদার মুক্ত দিবস আজ। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হটিয়ে ঝিনাইদহকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তিকামী বাংলার তরুণ বীর দামাল ছেলেরা। তখন ঝিনাইদহে প্রথম উদিত হয় লাল-সবুজের পতাকা।

ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ঝিনাইদহ জেলার নওজোয়ানরা মুক্তিবাহিনীর নির্দেশনানুযায়ী নিজেদের ভেতরে ও তাদের দোসর রাজাকারদের সমূলে বিনাশ করতে জীবন বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দেশে প্রথম যে সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা হয়েছিল ১ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালীতে। আর বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এই বিষয়খালীতেই।

১ এপ্রিলের এই দিনে পাকবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝিনাইদহ দখলের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে শুরু করে। খবর পেয়ে জেলার মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের জন্য বেছে নেন বিষয়খালীর বেগবতী নদীর সেতু। পাকবাহিনীকে রুখতে নদীর তীরের সেতু ভেঙে গুড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা।

এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর অন্তত ৮ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হয়। নদীর তীরের সম্মুখ যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে পাকহানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফিরে যায় যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে।

৪ এপ্রিল শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, ৪ আগস্ট একই উপজেলার আলফাপুর যুদ্ধ, ১৪ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধ ও ২৬ নভেম্বর কামান্না যুদ্ধ। এছাড়াও ৬ আগস্ট, ১৭ আগস্ট ও ১১ নভেম্বর জেলার বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিকে গেরিলা যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে, অপরদিকে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে (মিত্রবাহিনী) সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকহানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে।

বিভিন্ন এলাকা থেকে শত্রুমুক্ত হওয়ার সংবাদ আসতে থাকে। মুক্তিসেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণে পাকহানাদাররা যশোর ক্যান্টনমেন্টর দিকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৩ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মহেশপুর উপজেলা, ৪ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর উপজেলা ও ৫ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা।

এদিকে চুয়াডাঙ্গা এলাকা দিয়ে কপোতাক্ষ ও চিত্রানদী অতিক্রম করে ৬ ডিসেম্বর দেশমাতৃকার টানে মুক্তিকামীরা ঝিনাইদহে প্রবেশ করে জেলা শহর মুক্ত করে। এসব যুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলায় অন্তত ২৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ জেলায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে মাত্র দুইজন। তারা হলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলাম।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ মাস্টার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ হানাদার মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘর থেকে দলে দলে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উল্লাস করতে থাকেন। ফুল দিয়ে তারা মুক্তিসেনাদের বরণ করে নেন। ইতিহাসের পাতায় ঝিনাইদহবাসীর কাছে দিনটি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

তিনি আরো বলেন,‘বিজয় শুধু আনন্দ নিয়েই আসেনি, স্বজন হারানোর বেদনাও নিয়ে এসেছিল সেদিন। তবে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

(এইচআর/এএস/ডিসেম্বর ০৬, ২০২৫)