শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : বাঘা যতীন,পুরো নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।  কোনো অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি হাতে বাঘ হত্যা করার পর তাকে বাঘা যতীন নামে অভিহিত করা হয়।  তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম প্রধান নেতা।  ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের রিশখালি গ্রামে রয়েছে তার পৈতৃক ভিটা। ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের কিংবদন্তি এই নেতা।

তবে তার ছেলেবেলা কাটে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডুর উপজেলার রিশখালি গ্রামে। তার জন্মবার্ষিকী ৭ ডিসেম্বর। তবে পৈতৃক ভিটায় নেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, নেই ইতিহাস সংরক্ষণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। স্বাধীনতার এই মহান বীরের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক ভিটা আজ পরিণত হয়েছে উপেক্ষা, জরাজীর্ণতা ও বেদনার প্রতীকে। শৈশবের স্মৃতি আর ইতিহাসের নিদর্শন আজ বিলীনপ্রায়। রিশখালিই ছিল বাঘা যতীনের শৈশব ও প্রথম যৌবনের শিক্ষালয়। তাঁর চরিত্রে দেশপ্রেম,সাহস, মানবিকতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার শক্ত ভীত তৈরি হয়েছিল এই গ্রামে বেড়ে ওঠার সময়ই। কিন্তু আজ সেই পৈতৃক ভিটায় নেই বাড়ির কোনো সুস্পষ্ট চিহ্ন। ভিটে ঘেরা ঝোপঝাড় আর একটি পুরনো জমির সীমানাই কেবল জানান দেয়-এখানে কোনো এক সময় ইতিহাসের এক মহান বীর বাস করতেন। স্থানটিতে নেই কোনো তথ্যফলক, নেই স্মৃতিস্তম্ভ বা জাদুঘর। পথ নির্দেশক বোর্ডও নেই; বাইরে থেকে এলে চেনাই যায় না এটি বাঘা যতীনের জন্মভিটা।

জানা যায়, ১৯৮৭ সালে স্থানীয় কয়েকজন যুবক চাঁদা তুলে ৬ শতক জমি ক্রয় করে সেখানে তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ‘বিপ্লবী বাঘা যতীন একাডেমি’ নামে একটি ক্লাব গড়ে তুললেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেটিও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে বিপ্লবী বাঘা যতীনের পৈতৃক বসত ভিটা। নবগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষে ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে শৈশবে ওই গ্রামেই বাবা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা শরৎশশী ও বোন বিনোদ বালার স্নেহে বেড়ে ওঠেন এই বীর বাঙালি। বাবার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর মা ও বড় বোনের সঙ্গে কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে মামাবাড়ি চলে যান বাঘা যতীন। মৃত্যুর এতবছর পেরিয়ে গেলেও এই অগ্নিপুরুষের নিজ গ্রামে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে ওঠেনি তেমন কিছুই। পৈতৃক ভিটায় অরক্ষিত একটা ম্যুরাল ও আবক্ষ ভাস্কর্য ব্যতীত বাঘা যতীনের পৈতৃক ভিটে-মাটিতে কোনো চিহ্ন নেই। সম্মুখযুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন এবং বালাসোর হাসপাতালে ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ইতিহাসবিদদের মতে,বাঘা যতীন শুধু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়, উপমহাদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী নাম। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুগান্তর দল,ট্রাম্প কার্ড পরিকল্পনা, ওল্ডাসার সংঘর্ষ-সবকিছুই ব্রিটিশ শাসন কাঠামোর বিরুদ্ধে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

এদিকে স্থানীয়দের ক্ষোভ ও গ্রামবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি,বহুবার স্থানীয় প্রশাসন,জনপ্রতিনিধি এমনকি জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কোনো উন্নয়ন হয়নি।

আব্দুর রশিদ নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘বাঘা যতীনের মতো স্বাধীনতার মহান নেতার জন্মভিটা বছরের পর বছর অযত্নে পড়ে থাকতে দেখে খুবই কষ্ট হয়। ইতিহাস সংরক্ষণে স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেই।’

মঈন আহমেদ নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘স্থানটি সংরক্ষণ করা গেলে প্রতি বছর দেশ-বিদেশের গবেষক, পর্যটক ও শিক্ষার্থীরা এখানে আসতে পারেন। এতে রিশখালির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’

বিপ্লবী বাঘা যতীন একাডেমির সহ-সাধারণ সম্পাদক আবু কালাম আজাদ বলেন, ‘বাঘা যতীনের পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি,কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। রিশখালিতে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, বাঘা যতীনের সংগ্রাম ভিত্তিক ছোট জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ, গবেষণা কেন্দ্র, লাইব্রেরি, বার্ষিক সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান, রিশখালি গ্রামকে ‘বাঘা যতীন স্মৃতি গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা, পাঠ্যবইয়ে বাঘা যতীনের বীরত্বের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে পারলে টিকে থাকবে বাঘা যতীনের স্মৃতি। শুধু তা-ই নয়, এসব উদ্যোগ নিলে তরুণ প্রজন্মের দেশপ্রেম, মানবিকতা ও ত্যাগের মূল্যবোধ আরও জোরদার হবে।’

বাঘা যতীনের পৈতৃক ভিটা-স্মৃতি সংরক্ষণ ও সরকারীভাবে জন্মবার্ষিকী পালিত হবে কিনা জানতে হরিণাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঈষিতা আক্তারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।’

(এসই/এএস/ডিসেম্বর ০৬, ২০২৫)