ঝালকাঠি ও নলছিটি মুক্ত দিবস বিজয়োল্লাসের এক অবিস্মরণীয় দিন
মানিক লাল ঘোষ
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের জন্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ক্ষেত্রে। প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকা পাক-হানাদার মুক্ত হওয়ার খবরে বিজয়োল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মেতে উঠতেন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা।
দক্ষিণ বাংলার ইতিহাসে ৮ ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে রণাঙ্গনের সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ঝালকাঠি সদর উপজেলা, আজকের জেলা শহর এবং পার্শ্ববর্তী নলছিটি উপজেলাকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এটি ছিল দাক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বরিশালের মানুষের জন্য এক আনন্দময় মুক্তির বার্তা।
ঝালকাঠি অঞ্চল ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের অধীনে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি শহর ও নলছিটি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। ঝালকাঠি ও নলছিটি হানাদারমুক্ত হওয়ার আগে যে কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল নলছিটির চাচৈর যুদ্ধ।
এটি ১৩ নভেম্বর শুরু হয় এবং এখানে প্রচণ্ড বেগে যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল শহীদ হন, তবে বহু পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের মুখে এই যুদ্ধ হানাদারদের মনোবল ভেঙে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৫ নভেম্বর থানা কমান্ডার সেকান্দার আলীর নেতৃত্বে নলছিটি থানায় প্রথম আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাহমুদ চৌধুরীর মেয়েসহ কয়েকজন হানাদার প্রাণ হারান।
৭ ডিসেম্বর রাতে শহরে কারফিউ জারি হওয়ার পর, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকান্দার আলী আবারও নলছিটি থানা আক্রমণ করেন। এতে পাকসেনা, রাজাকার ও আলবদরদের পরাজয় ঘটে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিরস্ত্র করে তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
পরদিন ৮ ডিসেম্বর সকালে নলছিটি থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে এবং নলছিটি হানাদারমুক্ত হয়।
ঝালকাঠি শহর মুক্ত হওয়া-
১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ঝালকাঠি শহর দখলে নেয় এবং রাজাকারদের সহায়তায় ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অঞ্চলে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় নির্যাতন চালায়। সুগন্ধা নদীর পাড়ে (বর্তমান পৌর খেয়াঘাট) পোনাবালিয়া ও সাচিলাপুরের অনেক নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর রাতে শহরে কারফিউ জারি করে।
৮ ডিসেম্বর সকালে ঝালকাঠিতে অবস্থানকারী হানাদার মিলিশিয়া বাহিনীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পদ্মা পেট্রোলিয়াম ডিপোর ঘাটে গানবোট অপেক্ষা করতে থাকে। হানাদার বাহিনী শহরে কার্ফু জারি করে তাদের রসদ গানবোটে তুলে বেলা সাড়ে ১২টায় ঝালকাঠি শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর বিকেলে স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেলিম শাহ নেওয়াজের কাছে শত্রুবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঝালকাঠি সদর থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে এবং ঝালকাঠি শত্রুমুক্ত হয়।
এভাবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ৭ মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে ঝালকাঠি ও নলছিটিকে হানাদারমুক্ত করে।
ওয়েবসাইট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগ্রন্থ ও বিভিন্ন স্মারকিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝালকাঠি-নলছিটি অঞ্চল মুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার এবং তাঁর নেতৃত্বে এই অঞ্চলে অনেক সফল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নলছিটি উপজেলার চাচৈর যুদ্ধ ছিল শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে সংঘটিত অন্যতম বৃহৎ এবং সফল যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৩ ও ১৪ই নভেম্বর এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন। প্রথম দিনে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর, পরদিন তারা পুনরায় আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এই যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী ক্যাম্পের বাইরে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করতে সাহস পায়নি, যা অঞ্চলটির মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। অন্যান্য অভিযান: চাচৈর যুদ্ধ ছাড়াও তিনি এই অঞ্চলে অন্যান্য সফল অভিযানেও নেতৃত্ব দেন। শাহজাহান ওমরের বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বের ফলেই ঝালকাঠি ও নলছিটি অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর কার্যকর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হন, যা এই এলাকার স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বাঙালির চোখে তখন একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন মুক্ত স্বদেশের স্বপ্ন। নভেম্বরের শেষ দিক থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় এ স্বপ্নকে আরও বেগবান করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর ভোরের এই দিনে মুক্তিকামী রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে বিজয়ের বেশে ঝালকাঠি এবং নলছিটি শহরে প্রবেশ করেন। শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে এসে তাদের বীর সন্তানদের অভ্যর্থনা জানান আর তাদের কণ্ঠেও উচ্চারিত রণাঙ্গনের সেই সাহসী মুক্তির স্লোগান: "জয় বাংলা"। সেদিন বাতাসে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, আর সবার চোখে ছিল বিজয়ের আনন্দাশ্রু। আর পরিপূর্ণভাবে কখন পুরো বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা।
৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি ও নলছিটি মুক্ত দিবস কেবল একটি তারিখ নয়, নয় শুধু একটি দিবস উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা। এটি আমাদের সাহস, আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতা অর্জনের দীপ্ত চেতনা ও প্রতিজ্ঞার প্রতীক। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করি সেই সকল বীর শহীদদের, যাঁদের আত্মত্যাগ ও সাহসের বিনিময়ে আমাদের এই মহান স্বাধীনতা। এই দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক— মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন ও ধারণ করে, একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া।
তথ্যসূত্র : ওয়েবসাইট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও স্মরণিকা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
