দেলোয়ার জাহিদ


ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর এবং স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দৈনিক ইত্তেফাক ৭৩ বছরে পদার্পণ করেছে। এটি কেবল একটি সংবাদপত্রের বয়স নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক বিকাশ ও নাগরিক প্রতিরোধের এক জীবন্ত দলিল। ১৯৫৩ সালের উত্তাল সময়ে জন্ম নেওয়া ইত্তেফাক শুরু থেকেই আপসহীন সত্য, স্বাধিকার এবং গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ক্ষুরধার সম্পাদকীয় নেতৃত্বে ইত্তেফাক পাকিস্তানি বৈষম্য, নিপীড়ন ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে ইত্তেফাক ছিল জন-প্রতিরোধের ভাষাদুর্গ ও জনগণের দিশারি। স্বাধীনতার পরও গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনস্বার্থ রক্ষায় পত্রিকাটি দায়িত্বশীল ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। পক্ষপাতহীনতা, গঠনমূলক সমালোচনা এবং নৈতিক সাহস—এই গুণাবলির ইত্তেফাককে রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু আজ এই ‘চতুর্থ স্তম্ভ’-এর অস্তিত্বই গভীর সংকটে।

গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির ওপর সমন্বিত আক্রমণ: একটি বিপজ্জনক বার্তা

১৮ ডিসেম্বর ২০২৫—দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম ও সর্বাধিক প্রভাবশালী দুটি সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে সহিংস আক্রমণ, একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট-এ ভাঙচুর—এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। এগুলো স্বাধীন গণমাধ্যম, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুক্ত চিন্তার ওপর পরিকল্পিত ও সমন্বিত আক্রমণের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

একই রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে দীপু চন্দ্র দাসকে জনতার হাতে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে আরও নগ্ন করে তোলে। অথচ রাষ্ট্র, যার মৌলিক দায়িত্ব নাগরিকের জীবন রক্ষা, সে দায়িত্ব পালনে দ্রুত ও কার্যকর সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

উদ্বেগজনকভাবে, সরকারের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকেই অভিযোগ উঠেছে—এই সহিংস ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতার ভেতরের কিছু অংশ জড়িত থাকতে পারে। হামলার সময় সংবাদমাধ্যম দুটির প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ও কর্মীরা আগুনে আটকা পড়ে জীবনঝুঁকিতে পড়েছিলেন—এ তথ্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতাই নির্দেশ করে।

নীরবতা, জড়তা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি

এই সহিংসতার পর সংবাদপত্রের মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের হয়রানি ও শারীরিক ভয় দেখানো প্রমাণ করে—কার্যকর রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অনুপস্থিতিতে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে দমনে এক ধরনের সাহসিকতা জন্ম নিচ্ছে।

ছায়ানটের ওপর হামলা আরও বিস্তৃত একটি প্রবণতার দিক নির্দেশ করে—সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পী ও মতের বৈচিত্র্যের প্রতি ক্রমবর্ধমান বৈরিতা। অনলাইন ও অফলাইন সহিংসতার এই বিপজ্জনক সংমিশ্রণ, ঘৃণ্য বক্তব্যের বিস্তার, সমন্বিত হয়রানি এবং রাষ্ট্র-অনুমোদিত নজরদারির ধরণ দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে আরও পোক্ত করছে।

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো—কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও প্রকাশ্য সহিংসতার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন, যা তাদের অনুসারী ও সংগঠিত নেটওয়ার্ক দ্বারা আরও বিস্তার লাভ করছে। এতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মানবাধিকার সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আইনি ও নৈতিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে—বিশেষ করে ICCPR-সহ—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের ওপর বর্তায়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু লঙ্ঘন না করা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় উভয় পক্ষের সহিংসতা প্রতিরোধ, তদন্ত, জবাবদিহি নিশ্চিত ও প্রতিকার প্রদান করা।

২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়নের নজির, আর আজকের প্রেক্ষাপটে লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতার মুখে রাষ্ট্রীয় জড়তা—এই দুই চরমপন্থাই বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী।

উপসংহার ও সুপারিশ

বাংলাদেশ যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চায়, তবে চতুর্থ স্তম্ভকে দুর্বল করার এই প্রবণতা অবিলম্বে রুখতে হবে। এজন্য—

গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।

দায়ীদের—রাষ্ট্রীয় বা অ-রাষ্ট্রীয়—অবিলম্বে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

সাংবাদিক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য কার্যকর নিরাপত্তা ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

ঘৃণ্য বক্তব্য ও সহিংসতার আহ্বান রোধে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, রাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যম কোনো আপসযোগ্য বিষয় নয়।

ইত্তেফাকের ৭৩ বছরের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—গণমাধ্যম যখন নীরব হয়, তখন গণতন্ত্র অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ রক্ষা করা মানেই রাষ্ট্রকেই রক্ষা করা।

লেখক : স্বাধীন রাজনীতি বিশ্লেষক, মুক্তিযোদ্ধা,বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক এর সভাপতি (এডমন্টন, আলবার্টা, কানাডা)।