স্টাফ রিপোর্টার : কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ এবং শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা। ভোররাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে অবস্থানকারীদের শাপলা চত্বর থেকে উঠিয়ে দেওয়া। নানা তর্ক-বিতর্ক। রাজনীতিতে শুরু নতুন এক খেলা। আজ সেই ৫ মে। হেফাজত ইসলামের শাপলা চত্বরের অবস্থানের একবছর।

ভোর পাঁচটা ৫ই মে ২০১৩, ফজরের নামাযের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।

ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়দাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবরোধকারীদের মাঝে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা।

শাপলা চত্বরে যাওয়ার অনুমতির জন্য পুলিশের সাথে দফায় দফায় আলোচনা। এদিকে অনুমতি মেলার আগেই কয়েকটি মিছিল ঢুকে পড়ে এবং সংঘর্ষ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এবং পল্টন এলাকায়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে।

বেলা বারটা, সংঘর্ষ হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে। সেখানে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে আওয়ামী লীগের একদল নেতা কর্মী হামলা করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুপুর দেড়টা, ঢাকার প্রবেশপথগুলো থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা এসে অবস্থান নেয় শাপলা চত্বরে।

কিন্তু অন্যদিকে, পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকারম মসজিদের চারপাশের রাস্তায় বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ সহিংসতা চলতে থাকে। পুলিশও দফায় দফায় গুলি চালায়। প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নেয় গোটা এলাকা।

দিনের এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়। তবে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাদের বক্তব্যে সেখানে অবস্থান করার ঘোষণা আসতে থাকে।

রাত সাড়ে আটটা, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ঐ বিবৃতি সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কও হয়েছে।

অন্যদিকে, হেফাজতের নেতাদের অনেকেই মনে করেন, সে সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারে সর্ব্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে বড় ধরণের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার পাল্টা হিসেবে হেফাজতের ১৩ দফার আন্দোলনকে দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা ছিল কোন মহল থেকে।

রাত সাড়ে দশটা, পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রধান শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেয়।

কিন্তু কিছুটা পথ এসেই অসুস্থ এবং নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে শাহ আহমদ শফি ফিরে যান। তিনি আর আসেননি শাপলা চত্বরে। রাতে অবশ্য জমায়েতও অনেকটা কমে গিয়েছিল।

রাত সোয়া একটা, আলোচিত সেই রাতের অভিযানের প্রস্তুতি। পুলিশ, র‍্যাব,বিজিবির হাজার হাজার সদস্য তখন দৈনিক বাংলার মোড়, দিলখুশা, ফকিরাপুল এবং নটরডেম কলেজের সামনে অবস্থান নিয়েছে। অবস্থানকারীদের সরে পড়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর ষ্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা খোলা রাখা হয়েছিল।

অন্য তিন দিক থেকে র‍্যাব, বিজিবি পুলিশ সদস্যরা এগুনোর চেষ্টা করে এবং প্রথমে হাত মাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলে। কিন্তু মঞ্চ থেকেও আসতে থাকে উত্তেজনাকর বক্তব্য। ঘণ্টা দেড়েক এভাবে চলে।

রাত পৌনে তিনটা। শুরু হয় মুল অভিযান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ফাকা গুলি,আর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত রাউন্ড গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

প্রায় দশ মিনিটেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছে যান শাপলা চত্বরে।

অভিযানের সময় হেফাজতের শত শত কর্মী সমর্থক মতিঝিল এলাকায় বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ পুরো এলাকার দখল নেওয়ার পর বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেওয়াদের বের করে এনে ঐ এলাকা ছেড়ে যেতে সহায়তা করে।

ভোর চারটা, তখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থেমে ফাঁকা গুলি করেছে এবং তল্লাশি চালিয়েছে আশেপাশের ভবনগুলোতে।

রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখ দিয়েছিল। আড়াই হাজারের মতো নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলছিল বিভিন্ন দল। পুলিশ বলেছিল, অভিযানের সময় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা গিয়েছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ই এবং ৬ই মে দু’দিনে সারাদেশে ২৮ জনের নিহত হওয়ার কথা বলেছিল।

ভোর পাঁচটা, পুরো মতিঝিল এলাকার পরিবেশটা একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার মতো মনে হয়েছিল। আগের দিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্ন আশেপাশে ছড়িয়েছিল।

(ওএস/এটি/মে ০৫, ২০১৪)