লাকসাম থেকে চন্দন সাহা : কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের বেলতলী বধ্যভূমি। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসবে মানুষের হাড়-কংকাল। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা বিভিন্ন বয়সের বাঙ্গালী প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পর এ বধ্যভূমিটিতে এবার স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, করা হয়েছে সংরক্ষণ।

দেশের বৃহত্তম লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৈরি ব্যাংকারের পাশে প্রায় দুই হাজার ফুট এলাকা জুড়ে এ বধ্যভূমি। যেখানে গো-চারণ ভুমি এবং পথচারীদের মল-মুত্র ত্যাগের নিরাপদ জায়গায় পরিণত হয়েছিল।তবে নতুন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং সংরক্ষণ করায় এখন তা বন্ধ হয়েছে।

পাকসেনাদের নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গবেষণা সূত্রে জানা যায়, পাক বাহিনী দেশের অন্যান্য এলাকার মত ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল লাকসাম এলাকা দখল করে।এরপর পাকবাহিনী লাকসাম রেলজংশনের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে অবস্থিত থ্রি-এ-সিগারেট ফ্যাক্টরীতে ক্যাম্প স্থাপন করে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পর যুদ্ধকালীন পাকবাহিনীরা এ সিগারেট ফ্যাক্টরীকে মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে।

এ ক্যান্টনমেন্টের অধীনে ছিল লাকসামসহ কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ এলাকা, চাঁদপুর, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চল। এসব অঞ্চল থেকে পাক বাহিনী শ’শ’ যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষকে ট্রাকে করে তুলে নিয়ে আসত। এদের মধ্যে যুবতীদের উপর যৌন নিপীড়ন শেষে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতো। এখানে সব বয়সের ও ধর্মের লোকদের ধরে এনে হত্যার পর তাদেরকে ওই বধ্যভূমিতেই গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিত। বিশেষ করে ফেনী,নোয়াখালী,চাঁদপুর এবং বরিশাল অঞ্চলের ট্রেণে আসা যাত্রীদেরকেও পাক সেনারা রেলওয়ে জংশন থেকে ধরে নিয়ে যেত ওই থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরীতে। সেখানে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার পর বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেয়া হতো।

’৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাকসাম রেলজংশনে ঝাড়ুদারের কাজে নিয়োজিত উপেন্দ্র মালির সহযোগী তার ভাগিনা শ্রীধাম চন্দ্র দাস (৬০) তার দেখা সে সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান,’৭১ এর ১৫ এপ্রিল পাক সেনারা লাকসাম আক্রমণ করে।পরদিন লাকসাম জংশন প্লাটফরমে কয়েকটি বাঙ্গালীর লাশ বিক্ষিপ্ত পড়েছিল।তৎকালীন রেলওয়ে স্যানেটারী ইন্সপেক্টর আমাকে ডেকে নিয়ে লাশগুলো সরানোর আদেশ দেন।আমি নিজেই লাশগুলো রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে নিয়ে তার নির্দেশেই মাটি চাপা দেই। শ্রীধাম আরও জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চাঁদপুর ট্যোবাকো কোম্পানীর কারখানায় স্ব-চোখে দেখেছেন পাক সেনাদের চরম নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের বিভৎস কান্ড। সেখানে চাকুরী নেয়ার দু’দিন পর দেখলাম পাক সেনারা হত্যা করলো রেলওয়ে জংশনের পাশে অবস্থিত মিশ্রি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকসহ একদল বাঙ্গালীকে।

ওই সময় আমি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকের লাশ মাটি চাপা দেয়ার স্থানটিকে চিহ্নিত করে রাখি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে স্থান থেকে লাশ তুলে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে নেয়ার ব্যবস্থা করি। এছাড়াও ওই সময় সিগারেট ফ্যাক্টরী বিভিন্ন কক্ষে হানাদাররা আটক করে রাখত শত-শত বাঙ্গালী যুবতী মেয়েকে। তাদের ধর্ষণের পর নরপশুরা তাদের স্তন কেটে উল্লাস করে হত্যা করত! তিনি বলেন, সারাদিন বেলতলী ব্যাংকারের পাশে গর্ত খুঁড়ে রাখতাম। পরদিন সকালে সিগারেট ফ্যাক্টরী থেকে লাশগুলো এনে এখানে মাটি চাপা দিতাম। শ্রীধাম বলেন, সে সময়ের কথাগুলো মনে হলে রাতে ঘুম আসে না। নিজের জীবন এবং মা-বাবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি বাধ্য হয়েই তখন লাশ মাটি চাপা দেয়ার কাজটি করেছিলাম। কত লাশ দু’হাতে মাটি চাপা দিয়েছি তার হিসাব মেলাতে পারছিনা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বধ্যভূমিতে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশ্ববর্তী পাইকপাড়া গ্রামের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আবদুছ সোবাহান ও দরবেশ নূর ইসলাম নুরুকেও মাটি চাপা দেয়া হয়।

ওই সময় শুধু বধ্যভূমিতে লাশ মাটি চাপা দেয়া ছাড়াও ট্রেনে আসা শত-শত যাত্রীদের পাখির মত গুলি করে হত্যা শেষে তাদেরকে মালবাহী ট্রেনের বগি ভর্তি করে তা চাঁদপুর নিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিত।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান,’৯৯ সালে ঢাকার একদল সাংবাদিকদের অনুরোধে শ্রীধাম দাস বেলতলী বধ্যভূমি খুড়ে বের করে আনেন বেশ কয়েকটি মাটি চাপা দেয়া মানুষের হাড়-গোড়-কঙ্কাল-করোটি। এ সময় উদ্ধার করা বেশ ক’টি মাথার খুলি ও কিছু হাড় বর্তমানে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লাকসাম থানা কমান্ডের একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৮-১-৯৯ইং তারিখের সাবিম/শ-উঃ১/৯৯-১নং স্মারক মোতাবেক কুমিল্লা জেলা প্রশাসন ২৫-২-৯৯ তারিখে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বধ্যভূমির জায়গাটি অধিগ্রহণের নির্দেশ দিলেও তা ৪৩ বছর পর বাস্তবায়িত হল।

লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবদুল বারী মজুমদার জানান, যেভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে এবং ট্রেনের যাত্রীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা শেষে পাক বাহিনী প্রতিদিন এখানে মাটি চাপা দিত, সে হিসাব মতো প্রায় ১০ হাজার বিভিন্ন বয়সের নর-নারীর কম নয়!

(এএস/ডিসেম্বর ২৮, ২০১৪)