বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটের শরণখোলায় বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ওয়ামিপ (ডব্লিউএমআইপি) প্রকল্পের আওতায় পাউবো’র ৩৫/১ পোল্ডারের ক্ষতিগ্রস্ত ৭ কিলোমিটার (৭ হাজার ১০ মিটার) বেড়িবাঁধ মেরামত ও ব্লক স্থাপনের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৩২ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ হস্তান্তরের সর্বশেষ মেয়াদ এক মাস আগে শেষ হলেও নিয়ম বহির্ভুতভাবে এখনো চলছে কাজ।

এছাড়া নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় ইতোমধ্যে বাধের ৭-৮টি পয়েন্টে ধস নেমে ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বলেশ্বর নদের প্রবল ঢেউয়ে বাধের ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ অংশ সম্পূর্ণ বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজ শেষ হতে না হতেই বাধ ধসে পড়ায় এলাকাবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মকর্তারা এমন দুর্নীতি ও অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করছেন। ঠিকাদার ওইসব তদারককারীদের ম্যানেজ করেই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে সংঘটিত সুপার সাইক্লোন সিডরে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাধের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই বাধ মেরামতে বিশ্ব ব্যাংক ৩২ কোটি টাকা অর্থ সহায়তা দেয়। দরপত্রের মাধ্যমে দুই প্যাকেজে কাজটি পায় ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএস,এসি জয়েন্টভেন্সার। এর মধ্যে উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের তাফালবাড়ি (রায়েন্দা গ্রাম) লঞ্চঘাট থেকে বগী বন্দর পর্যন্ত প্রথম প্যাকেজে ৩ হাজার ৬৭৪ মিটার এবং ওই লঞ্চঘাট থেকে সন্ন্যাসী পর্যন্ত দ্বিতীয় প্যাকেজে ৩ হাজার ৩৩৬ মিটার। কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর। দুই বছর মেয়াদের এ কাজ হস্তান্তরের কথা ২০১৪ সালের ২ মার্চ। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার পর কয়েক দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে তা শেষ করতে না পারায় কাজের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে ২০১৫ সালের (চলতি বছর) ৩১ মার্চ পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু সেই মেয়াদেরও এক মাস অতিবাহিত হলেও কাজ এখনো শেষ হয়নি। নিয়ম বহির্ভুতভাবে দুর্নীতি-অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ঠিকাদার তড়িঘড়ি করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত বাধ প্রথমে মাটি দিয়ে মেরামত ও উচু করার কথা। সেখানেও অনিয়ম করা হয়। এর পর শুরু হয় ব্লক নির্মানের কাজ। ব্লকে ব্যবহার করা হয় নিম্নমানের পাথর। দেয়া হয়নি পরিমান মতো সিমেন্টও। পরবর্তীতে ব্লক স্থাপনের সময় শুরু হয় পুকুর চুরি। প্রথমে মাটির উপর ৪ ইঞ্চি বালু দিয়ে তার উপর জিও ব্যাগ এবং জিও ব্যাগের উপরে আরো ৪ ইঞ্চি ইটের খোঁয়া দিয়ে তার উপরে ব্লক স্থাপনের কথা। কিন্তু ব্লকের নিচে-উপরে ৪ ইঞ্চি করে বালু ও খোঁয়া কোনোটাই দেয়া হয়নি। এছাড়া, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ব্লক নির্মাণ করায় স্থাপনের সময়েই অনেক ব্লক ভেঙে গেছে। এমনকি, পুরনো ব্লকও বসানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে সাউথখালী ইউনিয়নের তাফালাবাড়ি লঞ্চঘাট, স্লুইস গেট, বগী, রায়েন্দা ইউনিয়নের রাজেশ্বর ও খোন্তাকাটা ইউনিয়নের কুমারখালীসহ ৭-৮ পয়েন্টে ধস দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন অংশের ব্লকসহ মূল মাটির বাধ নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এছাড়া, নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পরেও সন্ন্যাসী এলাকার ১ হাজার ১৮০ মিটার এলাকার কাজ এখনো চলমান রয়েছে। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।

তাফালবাড়ি লঞ্চঘাট (রায়েন্দা গ্রাম) এলাকার বাসিন্দা মোতালেব হাওলাদার (৬৫), আ. রশিদ হাওলাদারসহ (৭০) অনেকেই অভিযোগ করেন, কাজ শেষ হওয়ার আগেই বাধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে নদী ঢেউয়ে সম্পূর্ণ ভেঙে ঘরবাড়ি ভাসে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। কাজের মান খুবই খারাপ হয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।

সাউথখালী ইউনিয়নের ক্লাসিক স্পোর্টস ক্লাবের পরিচালক এইচ এম পলাশ মাহমুদ জানান, জিও ব্যাগের নিচে ও উপরে ৪ ইঞ্চি করে বালু ও খোঁয়া কোনোটাই দেয়া হয়নি। এছাড়া, ব্লকে মরা পাথরসহ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় অনেক ব্লক বসানোর আগেই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ পরিত্যাক্ত ঘোষনা করার পরেও রাতের আধারে এসব ব্লক বসানো হয়েছে। বাধে যেভাবে ভাঙন দেখা দিয়েছে, তাতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এই ৩২ কোটি টাকা কোনোই কাজে আসবে না। পুরনো বাধের ব্লকও বসানোর অভিযোগ করেছেন তিনি।
কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. আলতাব হোসেন কাজে অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, এসব বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাঈনুদ্দিন বলেন, কাজে অনিয়মের বিষয়টি তার জানা নেই। তবে, খোঁজ খবর নিয়ে অনিয়ম প্রমানিত হলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই প্রকল্পের ঠিকাদার মোঃ আঃ হক গোলাম হায়দার মুঠো ফোনে জানান,৩৫/১ পোল্ডারের মেরামতের কাজটি মধ্যে নদী সাশন না থাকায় আপত কালীন ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা গুলো সংস্কার করা হয়েছে মাত্র। সে ক্ষেত্রে ২/১ টি স্থান ধসে গেলেও কাজ সমাপ্তির পর আগামী এক বছর পর্যন্ত (তিনি) ঠিকাদার তার নিজ খরচে মেরামত করে দিবেন।

(একে/এএস/মে ১৭, ২০১৫)