শিবচরে ২ গ্রুপের সংর্ঘষে নিহত ২
মাদারীপুর প্রতিনিধি : আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংর্ঘষে যুবলীগ কর্মী আরশেদ মাদবর (৪০) ও শাহজাহান দরানী (৪০) নিহত হয়েছেন।
পুলিশ, এলাকাবাসী, দলীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ক্রীড়া সম্পাদক আতিক মাদবর ও সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ইব্রাহিম শিকদারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিলো।
মঙ্গলবার স্থানীয় ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়াকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একে কেন্দ্র করে ঐদিন সকালে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ক্রীড়া সম্পাদক আতিক মাদবরের ভাই যুবলীগ কর্মী আরশেদ মাদবর বাড়ির পাশের শাহজাহান দরানীর দোকানে গেলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে ঘেরাও করে। এসময় তারা আরশেদ মাদবরকে গুলি করে লাশ টেনে হিচড়ে ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে একটি ক্ষেতে ফেলে রাখে। অন্যদিকে একই সময় ঐ সন্ত্রাসীরা শাহজাহান দরানীকে পাশের ক্ষেতে নিয়ে গুলি করে পুকুরে ফেলে যায়।
পরে এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। নিহতদের শরীরে অসংখ্য গুলির চিহ্ন রয়েছে।
এ ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনা ও আতংক বিরাজ করলে এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এই ঘটনায় মাদারীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল, শিবচর উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
দলীয় ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ইব্রাহিম শিকদারের গ্রুপটি দলের মধ্যে ঢুকে দলের ভাবমূতি নষ্ট করেছে।
এরা ২০০১ সালের জতীয় নির্বাচনে তৎকালীন চার দলীয় জোটের লোক ছিল। ঐ সময় (২০০১ সাল ৯৬ সাল পর্যন্ত) বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ‘ইব্রাহিম বাহিনী’ নামে একটি সন্ত্রাসী দল গড়ে তোলে। তখন তারই ছেলে মোবারক শিকদারের নেতৃত্বে এলাকায় লুটতরাজ চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপকর্ম করেছে। নিরহ মানুষকে হয়রানি করে তারা টাকা পয়সা সংগ্রহ করতো। তখন ক্ষমতার জোরে পার পেয়ে যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (ইয়াজদ্দিন) সময় ২০০৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোট প্রার্থী ঐক্যজোট প্রার্থী বর্তমান মৃত দন্ডপ্রাপ্ত আসামী জামায়াতে ইসলামে সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ আলী আহ্সান মুজাহিদের পক্ষে মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে জোড়ালোভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়।
জরুরি আইন জারি থাকাকালীন বিগত সময়ের অপকর্মের জন্য সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন প্রায়াগকারী যৌথবাহিনীর হাতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম শিকদার আটক হন। তার ছেলে মোবারক শিকদার দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে রক্ষা পায়।
এরপর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ও ইব্রাহিম শিকদার চারদলীয় জোট প্রার্থী বা কখনো সতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অনুষ্ঠিতভাবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের (আওয়ামী লীগের) পক্ষে কাজ করেন। তিনি ইব্রাহিম শিকদার ‘কথিত ত্যাগী’ আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। সেখান থেকে আর তাকে দলের পিছনের সারিতে থাকতে হয়নি। তবে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুতুবপুর তৃতীয় স্থান লাভ করে বেশ সুবিধা করতে পারেননি। তাই আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারী দলের শক্ত ও বলিষ্ট নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভের জন্য ত্যাগী ও পরিক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা আতিক মাদবরের পরিবারের উপর হামলা চালানো হয়েছে বলে এলাকাসীর ধারণা করছেন।
এলাকাবাসী আরো অভিযোগ করে বলেন, ইব্রাহিম শিকদার ও তার ছেলের আধিপত্য জাগান দিতেই যুবলীগ কর্মী আরশেদ মাদবর তার ভাস্তি জামাতা শাজাহান দরানিকে প্রকাশে দিবা-লোকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে না শর্তে এলাকাবাসী আরো অভিযোগ করে জনান, সন্ত্রাসীরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। একজনের লাশ টেনে হিচড়ে পাশের পুকুরে নিয়ে যায়। আর আরশেদ মাদবরের লাশ পাশের গ্রামের ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়ির উঠোনে নিয় ফেলে। ইদ্রিস হাওলাদারের বাড়িতে (যেখানে গরু জবাই করে খাওয়ার কথা) ফেলে যায়। এসময় হত্যাকারীরা হাওলাদার বাড়ির লোকদেরও শাসিয়ে যায়।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল জানান, পুলিশ এ ঘটনায় ১২ জনকে আটক করেছে। এলাকার বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। এলাকায় র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকায় এখনও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার জানান, ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বৈধ না অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লাশ ময়না তদন্তের জন্য মাদারীপুর মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মাদারীপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে আনা হয়েছে। এছাড়া শিবচর থানা ও কুতুবপুর পুলিশ ফাড়ির সার্বক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাহবুবুর রহমান রাজীব জানান, নিহতদের শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন রয়েছে। হাসপাতালে আনার অনেক আগেই তারা দুজন মারা গেছে।
শিবচর থানার এসআই আবু তালেব জানান, শিবচর থানায় মমলা দায়ের করা হয়েছে। এলাকায় শিবচর থানার ওসি আ. সাত্তারের নেতৃত্বে পুলিশের একাধিক টিম অবস্থান করছে।
এভাবে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নৃশংস খুনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে স্থানীয় দলীয় কোন্দল মিটানোসহ আইন শৃংখলা বাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার দাবি জানান এলাকার সাধারণ মানুষ।
(এএ/পিবি/জুন ০৩,২০১৫)