বীরেন মুখার্জী

কথাশিল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পাঠকের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন এবং ভাবনা বিনিময়। একজন কথাশিল্পী জীবনের আলোকজ্জ্বল পরিণতি থেকে শুরু করে চারিপাশের পরিকীর্ণ-বিষণ্ণতা, রুগ্নতা, হতাশা-বঞ্চনা, অবক্ষয়, অবলোকন করে শিল্প নির্মাণে গভীর অনুশীলন করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্বদেশ ও বিশ্বের সমকালীন, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ঘটনাপ্রবাহ এবং জীবনের বৈচিত্রময় টানাপড়েন, ঘটনা- অণুঘটনা। মানবিক দায়বদ্ধতাও একজন শিল্পীকে শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রতি উৎসাহ জোগায়। যে শিল্পী জীবনের গভীর সত্যকে নিপুণ ও পক্ষপাতহীনভাবে তুলে ধরতে পারেন, সে শিল্পীর রচনা কালজয়ী হয়। সালাম সালেহ উদদীনের গল্প পাঠে এ সত্যই প্রতিভাত হয় তিনি এ ধারার লেখক। মানবজীবনের জটিল সঙ্কেতময়তা ছাড়া গড়পরতা যাপন তার গল্পের বিষয়বস্তু নয়। জীবনকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে, ব্যক্তিকে অনুসন্ধানের কৌশল তার গল্পের পরতে পরতে। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ নস্টালজিক হয়ে পড়া এ গল্পকারের স্বভাবজাত। যাপন যে কত আশ্চর্য তা যেমন তার গল্পপাঠে জানা যায়, তেমনি গল্পের পটভূমে মানবমনস্তত্ত্ব ও মানব সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়াদি ধরা পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে তার গল্প অলঙ্কারহীন কিংবা অতিসাধারণ ভাষায় রচিত মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সাধারণ কথামালার মাধ্যমেই তিনি জীবনের জটিল সত্যকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

আশির দশকের শেষভাগে ১৯৯৬ সালে ‘অদূরবর্তী কেউ’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি গল্পের ভুবনে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ‘প্রার্থনার দুইপর্ব’ (১৯৯৯), ‘টাকা জ্বলে ওঠে অন্ধকারে’ (২০০৪), ‘ধূলিরঙের মানুষ’ (২০০৪), ‘শহরে এখন শাদা কাক চোখে পড়ে না’ (২০০৫), ‘শীত ও অন্ধকারে আমরা’ (২০১২), ‘এভাবেই রাত এভাবেই দিন’ (২০১২) প্রকাশিত হয়। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠগল্প’, ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প’ ও ‘নির্বাচিত প্রেমের গল্প’। এ পর্যন্ত তার রচিত গল্প সংখ্যা ৯৬টি।
সালাম সালেহ উদদীনের গল্পের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মধ্যবিত্তের মানসিক দ্বন্দ্ব-সঙ্কট। এছাড়া রয়েছে জীবনের এক পরমসত্য মানব-মানবীর অলঙ্ঘনীয় কাম-চেতনা, উচ্চাভিলাসসহ অন্যান্য অনুষঙ্গ। বিশিষ্ট গল্পকার হরিপদ দত্ত তার গল্প সম্পর্কে বলেন, ‘নাগরিক জীবনের জটিল বাস্তবতা তার সামনে ফুলের শুদ্ধতা আর সজীবতাকে বাসি ম্লান কীটে খাওয়া প্রতীকি রূপ নিয়ে ধরা দেয়।’ সালাম সালেহ উদদীনকে সত্যিকার অর্থেই নগর জীবনের শুদ্ধতার অনুসন্ধানী হিসেবে আবিষ্কার করা যায়। তার বেশিরভাগ গল্পের চরিত্র মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবন থেকে নেওয়া। যে কারণে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো একটি বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি সমকালিন বাস্তবতাকেই যেন সামনে টেনে আনে। তিনি মানব-মানবীর মনোদৈহিক জটিলতার ভেতর দিয়েই সমাজকে বিশ্লেষণ করতে সচেষ্ট থাকেন। গল্পের পটভূমে সূচারু শিল্পীর তুলিতে আঁকেন দারিদ্র্য ও ক্ষুধার সম্মিলন। তার গল্পপাঠে মধ্যবিত্তের পলায়নবাদী, অস্থির ও ভঙ্গুর মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে। সমাজের উচ্চবিত্তের চাপে পিষ্ট হতে হতে যাদের মনস্তত্ত্ব জটিল এবং অস্বাভাবিক, বিপর্যস্ত এবং বিপথগামী।

প্রকৃতিতাড়িত মানুষের জীবনালেখ্য রচনার মধ্য দিয়ে তিনি একদিকে মানবজীবনের রহস্যপূর্ণ মনস্তত্ত্ব যেমন উন্মোচনে সচেষ্ট থেকেছেন তেমনি সমাজের অন্ধকার দিকটির প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। সালাম সালেহ উদদীনের একটি বিশেষ ঝোঁক রয়েছে সেই সব চরিত্র সৃষ্টিতে, যারা নারীলোলুপ, যৌনতাড়িত এবং বিচিত্র বিকারগ্রস্ত মানসিকতা সম্পন্ন। তার সৃষ্ট চরিত্রের কেউ কেউ ছলনা ও ভন্ডামির আশ্রয় নেয় শুধুমাত্র নারী শরীর পাওয়ার আশায়। নারীর পেছনে অকাতরে অর্থ ও সময় ব্যয় করে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও নারীবিমুখ না হওয়া মানুষের গল্প তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পে। কখনো বিষয় আবার কখনো বিষয়হীনতাকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। বেশিরভাগ গল্পের চরিত্র জীবনের বিভিন্ন টানাপড়েন, হতাশায় নিমজ্জিত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে থাকে। এবং এই বিচ্ছিন্ন ও অপূর্ণতার মাঝেও সে একধরনের প্রশান্তি লাভ করে। জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী, কবি ও দার্শনিক নীৎসে মনে করতেন, মানুষের নিঃসঙ্গতা জন্মসূত্রেই প্রাপ্ত। তিনি বলেছেন, মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ আর নিঃসঙ্গচেতনার ইতিহাস আজকের নয়। সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে এই বোধ জাগ্রত হয়েছে সচেতন, স্বশিক্ষিত মানুষের মননে। কারণ সমাজ ব্যবস্থা যতই ভারসাম্যপূর্ণ অথবা বৈষম্যহীনই হোক না কেন, মানুষ অতৃপ্ত হবার মতো এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে এই পৃথিবীতে। সালাম সালেহ উদদীন সৃষ্ট চরিত্রগুলোও যেন নীৎশের এই ভাবনার বাস্তবতা নিয়ে জেগে থাকে।

গ্রামীণ পটভূমে রচিত ‘অদূরবর্তী কেউ’ এবং ‘প্রার্থনার দুই পর্ব’ গল্প দুটি প্রকৃতির বৈরিতার সঙ্গে গ্রামের মানুষের নিরন্তর মোকাবিলা, প্রেম-ভালোবাসা, জীবনযাপন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি বিষয়ের সমাহার নিয়ে রচনা করেছেন তিনি। ‘অদূরবর্তী কেউ’ গল্পটিতে নদীভাঙা মানুষের হাহাকার তীব্র হয়ে ওঠে। প্রকৃতি যাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বঞ্চনার খেলা করে, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিয়ে যারা জীবনের আখ্যান রচনা করে তারই সাক্ষ্য বহন করে গল্পটি। ‘প্রার্থনার দুই পর্ব’ গল্পে তুলে ধরেছেন নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। পতনমুখী তরুণদের মানসিক সঙ্কট ও মানুষের বিচিত্র মনোজগত উন্মোচনের চেষ্টা রয়েছে গল্পটিতে। দুর্নীতির জালে বন্দি সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তবতা নিয়ে রচিত সাংকেতিক গল্প ‘তেলাপোকা এবং হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।’ ‘তার মানুষ দেখা’ গল্পে মার্ক্সীয় শ্রেণিসংগ্রাম ও নিম্নবর্গ মানুষের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা লক্ষনীয়। বাম রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে গল্পের নায়ক মানুষে মানুষে ভেদাভেদের দেয়াল ভেঙে ফেলতে প্রত্যয়ী হয়। কিন্তু অবশেষে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে বুঝতে পারে পূঁথিগত বিদ্যা আর বাস্তব জীবন এক নয়। এ গল্পে রাজনৈতিক আদর্শশূণ্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শহর কিংবা উপশহরের তরুণদের ক্রমশ অপরাধপ্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়ার কাহিনী বিবৃত হয়েছে ‘তৃতীয় আগন্তুক’ গল্পে। তীর্যক ও বিদ্রুপ বর্ণনা ভাষ্যে রচিত এ গল্পটি সমকালিন রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্রই ফুটে ওঠে। বয়সী একটি বৃক্ষ নিয়ে রচিত গল্প ‘অনন্য বৃক্ষ ও পাখপাখালি।’ যে বৃক্ষটি ধ্বংসশীল জীবন ও সভ্যতার প্রতীকরূপে নানা ঘটনার সাক্ষী। কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সমীর আহমেদ এ গল্পটি নিয়ে বলেন, ‘পাখপাখালি, কীটপতঙ্গ এখানে জীবন ও সভ্যতার অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে।ৃ পাখপাখালি, কীটপতঙ্গকে আশ্রয় দিতে দিতে একদিন যান্ত্রিক সভ্যতার বিষবাষ্পে এবং বৃক্ষের নিচে গভীর রাতে মানুষের সংঘটিত কুকর্মের পর অসুস্থ হয়ে রুগ্ন, কঙ্কালসার মানুষের মতো পত্রশূন্য ডালপালা শূন্যে তুলে ধরে কিছুদিন দাঁড়িয়ে থেকে একদিন হঠাৎ পুকুরের জলে ধপাস করে পড়ে যায়। এই পড়ে যাওয়াটাই জীবন ও সভ্যতার পতনের প্রতীকরূপ।’ তার গল্প একদিকে স্বদেশের সমকালিন বাস্তবতা ধারণ করে অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও উঠে আসে।
নগরজীবনের উচ্ছ্বাস ও অন্ধকারময় দিক সালাম সালেহ উদদীন নানাভাবে দেখেছেন, নানামাত্রায় বিশ্লেষণও করেছেন। চরিত্রের জটিল আবর্তনের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলতে সচেষ্ট থেকেছেন ক্ষরিত সমাজের অস্থিরতা। কিন্তু সমকালের সমাজবাস্তবতা, বিচিত্র নৈরাজ্য ও বিকারগ্রস্ততাকে উদঘাটন করেই আধুনিক সাহিত্যিকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মানুষের অস্তিত্বের যে স্তরগুলি থাকে অপরিচয়ের ধূপছায়ায় আচ্ছন্ন, আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে তার উন্মোচনও জরুরী হয়ে পড়ে। সালাম সালেহ উদদীনের গল্পে চেতন ও অবচেতনের ঐকতানে জীবনের সামগ্রিক স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস তীব্রভাবে লক্ষ করা যায়। যা একজন সার্থক শব্দশিল্পীর পরিচায়ক। তার গল্পের কিছু বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা যেতে পারে
১. অর্থনৈতিক সঙ্কটের আবর্তনে মধ্যবিত্তের আহাজারি।২. প্রবল যৌনাকাঙ্খা, পরিণামে ব্যর্থতাজনিত নৈরাশ্য।৩. প্রকৃতির বৈরিতায় বিপর্যস্ত নিঃসঙ্গতা ও হাহাকার।৪. নাগরিক ও গ্রামীণ মানুষের যাপন প্রভেদ।৫. দাম্পত্য সঙ্কট, বিচ্ছিন্নতা ও মনোচেতনা উন্মোচন।৬. প্রকৃতিতাড়িত পুরুষের স্বরূপ অন্বেষা।৭. নিম্নবর্গের মানুষের নিয়ত সংগ্রাম।৮. পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজার অর্থনীতির হঠকারিতা।

সালাম সালেহ উদদীনের গল্পে ‘কতটুকু গল্প’ সে প্রশ্ন তর্কাতীত। তবে তার গল্পভাষ্য সরল ও একরৈখিক। কেউ কেউ সাংবাদিক প্রতিবেদনধর্মী বলেও মন্তব্য করেন। হতে পারে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার কারণে তার গল্পের ভাষাটা অত্যন্ত সরল এবং সাদামাঠা, যেখানে বাকচাতুর্য নেই। কিন্তু এই আপাতসরল বর্ণনার মাধ্যমে তিনি সমাজের গভীর ক্ষতটিকে শনাক্ত করেন। চোখে আঙুল দেখিয়ে দেন সমাজের মানুষ কোন জটিলতায় দিনযাপন করে। অনেক সময় মানুষ কী চায় তা সে নিজেই স্থির করতে পারে না। আবার জীবন সংগ্রামে মত্ত থাকতে থাকতে এক সময় সামনে চলে আসে অতৃপ্ত প্রসঙ্গটি। এসব দৃশ্য নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে সালাম সালেহ উদদীনের গল্পের জমিনে।

জীবনকে নানামাত্রিক আবর্তনে, উল্টে-পাল্টে দেখতে অভ্যস্ত তিনি। জীবনকে দেখেন প্রকৃতি ও সভ্যতার প্রতিরূপ হিসেবে। ‘সময় ও সময়ান্বিত মানুষই সালাম সালেহ উদদীনের অন্বিষ্ট। যে কারণে তার গল্পে সমাজ বাস্তবতার দিকটি কখনো উপেক্ষিত হয়নি।’ তিনি মূলত জীবনের জটিল আবর্তনই চিত্রায়িত করে চলেছেন।




(ওএস/এসসি/জুন২৯.২০১৫)