আঞ্চলিক প্রতিনিধি(বরিশাল):ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে একসাথে পরিবারের সকলকে নিয়ে আনন্দ করা। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাত করা। ভাব বিনিময় করা। কিন্তু সকল প্রকার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বরিশালের বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ ও বিভাগীয় বেবী হোমের আশ্রিত শিশুরা।

বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রিতদের ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, নাতী-নাতনী থেকেও আজ অপনজন বলতে তাদের কেউ নেই। তাই প্রতিবছর অসহায় নিঃসঙ্গ ওইসব আশ্রিত বৃদ্ধদের ঈদের দিনেকাটে চোখের জ্বলে মহাকষ্টে। এমনকি ঈদের দিনও তাদের খোঁজ নিতে আসেনা পরিবারের কেউ। বেবী হোমের শিশুদের জন্য ঈদের দিন নানা উৎসবের আয়োজন করা হলেও তারা কাছে পায়না কোন আপনজনকে। অধিকাংশরা শিশুরাই জানেনা তাদের পিতা-মাতার পরিচয়।

নগরীর আমতলার মোড় সংলগ্ন শান্তি নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রিতদের খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেছে অজানা লোকহর্ষক কাহিনী। এখানকার আশ্রিত অধিকাংশ বৃদ্ধের চোখের পাতায় মোটা দাগের রেখা স্পষ্ট। মুখজুড়ে বিষন্নতার ছাঁপ। উস্কুখুস্কু পাকা চুল। একটু চলাফেরা করলেই বয়সের ভাড়ে হাঁপিয়ে ওঠেন। তবুও প্রতিদিন তারা দুই মিনিটের পথ হেঁটে শান্তি নিবাসের প্রধান ফটকে পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন যদি দেখা মেলে সন্তানদের। একপর্যায়ে ধৈর্য্য হারিয়ে তারা ফিরে আসেন। আবার আশা নিয়ে ছুঁটে যান প্রধান ফটকে। আশা ভঙ্গের এমন নিস্ফল চেস্টা চলে দিনে কয়েকবার। এভাবেই স্বজনদের প্রতীক্ষায় সন্ধ্যা নেমে আসার পর চোখের জ্বল ফেলে তারা ফিরে আসেন নিজ নিজ কক্ষে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় তারা ঘুমিয়ে পড়েন।

শান্তি নিবাসে মনের অশান্তি নিয়ে বসবাসকারী ৭১ বছরের সালেহা বেগম, বৃদ্ধা আমিরুন নেছা, রিজিয়া বেগম, সুফিয়া বেগমসহ অনেকেই জানান, আমরা এখন বাতিলের খাতায়। আমাগো নিয়ে সন্তানদের ভাববার সময় নেই। সারাদিন তারা ব্যস্ত থাকে। তাই গত কয়েক বছর ঈদের দিনেও তারা আমাদের খোঁজ নিতে আসতে পারেনি। বলেই অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে ওইসব বয়োবৃদ্ধরা।

ওই নিবাসে আশি বছরের আরেক বৃদ্ধা কদবানু বেগম তার অতীতের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, পটুয়াখালীর বড়বিগা গ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। সন্তানদের মুখে দু’মোঠো ভাত তুলে দিতে রায়টের আগে স্বামীর সাথে সন্তানদের নিয়ে বরিশাল শহরে আসি। এরপর দুর্ভিক্ষ, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা সংকটের মুহুর্তেও সন্তানদের আগলে রেখেছি। এমনও হয়েছে দু’দিন ধরে নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়েছি। ঝড় ঝাপটায় বুকে আকলে রেখেছি। এরপর সন্তানরা বড় হয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে একে একে সবাই যে যারমতো করে থাকতে শুরু করে। ওদের সাথে আমাকে রাখা বোঝা মনে হতো। তাই নিজের ইচ্ছায় একদিন চলে আসি শান্তি নিবাসে। প্রায় ১৩ বছর ধরে এখানে আছি। সন্তানদের কথা স্মরণ করে তিনি আরও বলেন, চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ভোলা-বরিশাল রুটের লঞ্চে চাকুরী করে। আরেকজন থাকে স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায়। চার মেয়ের মধ্যে তিন মেয়ে বরিশাল ও ছোট মেয়ে নলছিটিকে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। এখানে আসার পর থেকে ঈদের দিন তাকে কেউ দেখতে আসেনি এটাই তার বড় দুঃখ। তিনি বলেন, অন্তত ঈদের দিন ছেলে-মেয়ে ও নাতীদের দেখা পাবো সেই আশায় কোনমতে হেঁটে গেটের সামনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। একসময় অধৈর্য্য হয়ে চলে আসি। ঘন্টাখানেক পর আবার দেখা পাবার আশায় গেটের সামনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াই। সন্ধ্যা নেমে গেলেও পরিচিত কাউকে না দেখে চোখের পানি ফেলে রুমে চলে আসি। মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে মাঝেমধ্যে কাঁদি। কক্ষে গিয়ে নিজেকে বোঝাই, হয়তো ব্যস্ততার কারনে কেউ আসতে পারেনি, কাল আসবে। এমন কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যাই টেরও পাইনা। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সন্তান ও নাতীদের নিয়ে একসাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে এখনও খুব ইচ্ছা হয়।

শান্তি নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে থাকা বরিশাল সেফ হোমের উপ-তত্ত্বাবধায়ক শ্যামল সেন গুপ্ত বলেন, প্রতিবছর ঈদের আগে আশ্রিত বৃদ্ধাদের নতুন কাপড়, গামছা, বিছানার চাদরসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুসহ ঈদের দিন তাদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।

জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার সেরাল গ্রামের শহীদ আব্দুর রব ছেরনিয়াবাত বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানায় গিয়ে কথা হয় সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে। তারা যখন কথা বলছিলেন, তাদের কন্ঠে ফুটে উঠেছিলো অভিমান আর কষ্ট। গৌরনদীর জঙ্গলপট্টি গ্রামের বৃদ্ধা কদভানু বিবি (৭৬) বলেন, প্রতি ঈদে যতোক্ষন না সন্তানদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারতাম ততক্ষণ শান্তি পেতাম না। ওদের আনন্দই ছিলো আমাদের আনন্দ। ঈদের দিন তৈরি করা খাবার প্রথমেই সন্তানদের মুখে তুলে দিতাম। প্রায় একযুগ সেই সন্তানদের মুখ দেখতে পাইনা। প্রতি বছরই ঈদ আসে, ঈদ যায়, কিন্তু সন্তানরাতো আর আসে না।

বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানায় আশ্রিতদের অন্য, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ সকল ব্যয়ভার বহন করেন প্রতিষ্ঠাতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঈদসহ অন্যান্য সময়ে বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানায় আশ্রয় নেয়া বৃদ্ধ ও এতিমদের জন্য নতুন জামা-কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি ও বিভিন্ন খাবার সামগ্রী দিয়ে থাকেন।

বৃদ্ধ আব্দুস সোবাহান (৮১) কান্নাজরিত কন্ঠে বলেন, ঈদ আসলে কষ্টটা আরও বেড়ে যায়। নড়াইলের ৮৫ বছর বয়সী আক্কেল আলী বিছানায় পড়ে আছেন। উঠে দাঁড়াবার শক্তি পর্যন্ত তার নেই। তিনি বলেন, এখনও অপেক্ষায় আছি, সন্তানরা বুঝি আমাকে নিতে আসবে। দাসপট্টির ৯০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আক্কেল আলীও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, আর না হোক ঈদের দিন হলেও তার আদরের সন্তানেরা তাকে দেখতে আসবে।

বরিশালের বিভাগীয় বেবী হোম আগৈলঝাড়ার গৈলায় অবস্থিত ছোটমনি নিবাসের আশ্রিত অনাথ শিশুদের কোনদিনই বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তাদের অনেকের বাবা-মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আবার অনেকের বাবা-মায়ের পরিচয়ই জানা নেই। তাই বাবা-মায়ের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করারও তাদের কোন সুযোগ নেই। তার পরেও পিতৃ-মাতৃ স্নেহে লালন-পালন করা বেবী হোমের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনাথ ও এতিম শিশুদের ঈদের আনন্দ দেয়ার জন্য প্রতিবছরই সাধ্যমতো চেষ্টা করেন।

ছোটমনি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম আজাদ জানান, বর্তমানে ছোট মনি নিবাসে বিভিন্ন বয়সের ৩০ জন অনাথ শিশু রয়েছে। ঈদের আগে এসব শিশুদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত নতুন জামা কাপড় দেয়া হয়। ঈদের দিন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাসহ আনন্দ বিনোদনের জন্য দিনভর নানাকর্মসূচীর আয়োজন করা হয়।

সূত্রমতে, বেবী হোমে আশ্রিত অধিকাংশ অনাথ শিশুদের জন্ম হয়েছে কোন অন্ধ গলিতে, কারো ফুটপাতে, আবার কারো পরিচয় না থাকায় পথশিশু হিসেবে এখানে তাদের ঠাঁই মিলেছে।


(টিবি/এসসি/জুলাই১৪,২০১৫)