আরিফুন নেছা সুখী : ‘বন্ধু মানে নীল সাগরে উছলে পড়া ঢেউ/মনের মতো খুঁজে পাওয়া কেউ। বন্ধু মানে দূরে থেকেও অনেক কাছাকাছি/ সকাল বিকাল জানিয়ে দেয়া বন্ধু আমি আছি...’ বন্ধু মানে দুই দেহ এক প্রাণ। বন্ধু মানে নির্ভরতা, বন্ধু মানে তোমার জন্য মরতে পারির উদারতা। বন্ধু একটি শব্দ, যার বিস্তৃতি অসীম। বন্ধুত্বের কাছে হার মানে রক্তের সম্পর্কও। মা-বাবা, ভাই-বোনকে যে কথা বলা যায় না, সে কথা বন্ধুকে বলা যায় নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায়।

সেই বন্ধুত্বের বন্ধনকে মর্যাদা দিতে আগস্টের প্রথম রবিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বন্ধু দিবস। এবারের বন্ধু দিবস আজ ২ আগস্ট। এই দিনে বন্ধুকে জানানো হয় শুধুই বন্ধুত্বের কথা। হয়তো কোনোদিন বলা হয়ে ওঠেনি। বন্ধু, তোকে আমি অনেক ভালোবাসি। তাই অন্তত একটি দিন নির্ধারণ করা হয়েছে, যেদিন বন্ধুকে বলা হয় মনের না-বলা অনেক কথা, আবার দেয়া হয় বিভিন্ন উপহারসামগ্রীও। এবারের বন্ধু দিবসের ভাবনা জানার প্রয়াসে কথা হয় কয়েকজন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে। বন্ধু দিবসে তারা কীভাবে তার বন্ধুকে উইশ করবে কিংবা কোন বন্ধুকে বেশি মিস করবে। কিংবা কী উপহার দেবে বন্ধুদের, সে প্রসঙ্গে কথা হয় ইডেন মহিলা কলেজের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী আবে জমজম ঊষা জানান, ‘আমি সারা বছর অপেক্ষায় থাকি এই বন্ধু দিবসের জন্য। এই দিনটি আমার কাছে অনেক আকাঙ্ক্ষিত, অনেকটা উত্সবের মতো। এদিন আমরা বন্ধুরা মিলে খুব মজা করি। বাইরে ঘুরতে যাই এবং সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি। একে অপরকে ফ্রেন্ডশিপ বেল্ট বেঁধে দিই। আবার একে অপরকে বিভিন্ন উপহার দিই। তবে এবারের ফ্রেন্ডশিপ ডে’টা একেবারে নিরামিষ যাবে; কারণ ক’দিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা, তাই ঘুরতে বের হওয়া হবে না। কিন্তু মোবাইলে ওদের উইশ করব।’

সাহাবুল ইসলাম একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। বন্ধুত্ব বিষয়ে কথা বলতেই তিনি বলেন, নানান ব্যস্ততার কারণে বন্ধুদের খোঁজই নেয়া হয় না। তবে স্টুডেন্ট লাইফটা খুব ফিল করি। সবার কথা সত্যি খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে, মাধ্যমিকে পড়ার সময়টাকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় মনে করি। এখানে বন্ধু-বান্ধবীরা একসঙ্গে ক্লাস করতাম; কিন্তু আমরা কখনও কে ছেলে কে মেয়ে—এই বিভেদটা করতাম না। সবার সঙ্গে এত ভালো সম্পর্ক ছিল যে, একদিন কেউ স্কুলে না এলে তাকে দেখতে সবাই মিলে তার বাড়ি যেতাম। আমাদের যেদিন বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেদিন আমরা সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এমনকি কান্নাও করেছিলাম। এখন ভাবি, আমি কি সে-ই, যে ওইসব ছেলেমেয়ের জন্য চোখের পানি ফেলেছিলাম। অথচ আজ অনেকের চেহারা মনে নেই, এমনকি কারও কারও নাম পর্যন্ত মনে নেই। তবে সাব্বির, আক্কাস, আরিফ, বজলু, আসলাম, জেসমিন, সম্পা, ঝর্ণা, লোপা, শান্তি—এদের কথা বেশ মনে পড়ে। এদের মধ্যে দু’একজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা হয়। ইচ্ছা আছে, ফ্রেন্ডশিপ ডে’তে বন্ধুদের মোবাইল নম্বর জোগাড় করে তাদের মোবাইল করে বলব—তোদের খুব মিস করি। তবে একটি কথা না বললেই নয়, আমার এক বান্ধবী, নাম সানজীদা আক্তার শান্তি, যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালে আত্মহত্যা করে। কেন জানি না, ওর কথা আমার খুব মনে হয়। জানি না, ও পৃথিবীতে নেই বলেই ওকে এত বেশি ফিল করি কি-না!

লাবণ্য আদিতি, অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বন্ধু দিবস নিয়ে আলাপকালে তিনি জানান, এবারের ফ্রেন্ডশিপটা নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এটা আমার ভার্সিটি জীবনের প্রথম ফ্রেন্ডশিপ ডে। এই দিনটাতে আমরা খুব মজা করব। এর আগে স্কুলে ও কলেজে ফ্রেন্ডশিপ ডে সেলিব্রেট করতাম। সেটা ছিল দিনের বেলায়। এবার আমি যেহেতু আমি হলে থাকি, তাই রাত বারোটা এক মিনিটে মোমবাতি জ্বালিয়ে ফ্রেন্ডশিপ ডে’র কেক কাটব, ফ্রেন্ডদের হাতে ফ্রেন্ডশিপ বেল্ট বেঁধে দেব। যারা আমার থেকে দূরে থাকে, তাদের মোবাইলে উইশ করব। তাছাড়া আমি বিভিন্ন সময় আমার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। কিন্তু আমার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড মুমু মাঝে মাঝেই তার ফোনটা বন্ধ রাখে। তাই তাকে কখনোই সময়মত উইশ করতে পারি না। তবে এটা মানতেই হয় যে, অনেক ফ্রেন্ড পেলেও মুমুর মতো পাইনি। তাই হলে এসে আমাকে ফ্রেন্ড নির্বাচন করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তবে এখন আমার কয়েকজন ভালো বন্ধু হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, যেদিন আমি প্রথম হলে এলাম, সেদিন আমার খুব খারাপ লাগছিল; কিন্তু এখন হলে থাকতেই বেশ ভালো লাগে। এই ভালো লাগার পুরো কৃতিত্ব আমার বন্ধুদের। বিশেষত আমার বন্ধু আফসানার।

অরণ্য অতিন্দ্রিলা, একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। বন্ধু দিবসের কথা উঠতেই বলল, আসলে বন্ধু দিবসে বন্ধুদের সঙ্গে একটু সময় কাটাব, তা খুব একটা হয় না। একটু দেরিতে বাড়ি ফিরলেই মা-বাবা প্রচণ্ড বকাবকি করেন। তাই হাই-হ্যালো বলেই দিনটি কোনোরকম উদযাপন করি। আবার মোবাইলে উইশ করতে গেলেও নানা কথা শুনতে হয়। আমার বন্ধুরা মেসেজ পাঠালেও আমি মেসেজ পাঠাতে পারি না, খুব খারাপ লাগে।

সুপ্রিয় সিকদার ডেন্টালের ছাত্র। বন্ধু দিবস নিয়ে তেমন একটা বিশেষ ভাবনা নেই তার। তিনি বলেন, আমি মনে করি বন্ধুত্বের জন্য কোনো দিবস লাগে না। বছরের পুরোটাই বন্ধুদের জন্য। এখানে কোনো বিশেষ দিনে তাকে উইশ করব, ফ্রেন্ডশিপ ডে বেল্ট বাঁধব, গিফট করব। এসব মানে একটা দিনের গণ্ডিতে বন্ধুত্বকে বেঁধে ফেলা। বন্ধু সবসময়ের জন্য, প্রতিটি ক্ষণের জন্য। বন্ধুত্ব এমনই একটি বন্ধন, যে বন্ধনে কোনো সুতা নেই। এটা কোনো রক্তের সম্পর্ক নয়। এ সম্পর্ক আত্মার সঙ্গে আত্মার। চেনা নেই, জানা নেই, দেখা নেই, শোনা নেই—একদিন হঠাৎ দেখা, তারপর পরিচয়, চেনাজানা, দেখাশোনা। ব্যস, হয়ে গেল এক বন্ধন। এরই নাম বন্ধুত্ব। আর এই বন্ধনের সৃষ্টি হয় বলেই মা-বাবা ভাই-বোন ছেড়ে যখন কোনো ছেলেমেয়ে বাড়ির বাইরে আসে—ওঠে কোনো হোস্টেলে বা মেসে। আমারা বন্ধুরাই আমার সম্পদ।

১৯৩৫ সাল থেকে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্ধু দিবস। কথিত আছে, ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। ওই ব্যক্তিকে হত্যার প্রতিবাদে পরেরদিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করে। এই থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ আগস্টের প্রথম রবিবার বন্ধু দিবস পালিত হয়।
আসলে বন্ধুত্ব শব্দটি কয়েকটি বর্ণের মিলন হলেও এর বিস্তৃতি বিশাল। বন্ধুর হৃদয় হয় আকাশের মতো সীমাহীন, সাগরের মতো দিগন্তজোড়া। তাই বন্ধু দিবসে সব বন্ধুত্বের বন্ধন আরও অটুট হোক—এই শুভ কামনা। ভালো থেকো বন্ধু।

(ওএস/এএস/আগস্ট ০২, ২০১৫)