বাগেরহাট প্রতিনিধি : শীত মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের উপদ্রব থাকলেও এবার বর্ষায় ইলিশ মৌসুমকে টার্গেট করে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধ অনুপ্রবেশ করে লুটে নিচ্ছে রূপালী ইলিশ।

ভারতীয় এসব জেলেদের অনুপ্রবেশের কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের জেলেরা। স্থানীয় জেলেরা অভিযোগ, ভারতীয় জেলেদের উৎপাতে দেশি জেলেদের বর্তমান মৌসুমে ইলিশ মাছ আহরন ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

সর্বশেষ গত সোমবার চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অপরাধে ৩টি ফিসিং ট্রলারসহ ৪২ ভারতীয় জেলেকে আটক করেছে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সদস্যরা।

বাংলাদেশী জেলেরা জানান, একসময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমা ঘেঁষে বা কিছুটা ভেতরে ঢুকে ইলিশ শিকার করতেন। বর্তমানে বাংলাদেশ জলসীমার অনেক ভিতরে ঢুকে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি এসেও অবাধে মাছ শিকার করছেন।

অধিকাংশ সময়ই তারা গোপনে মাছ শিকার করে চলে যায়। বিদেশি জেলেরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎপরতায় চোখ রাখে। বিদেশী জেলেরা বাংলাদেশি জেলেদের বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে মাছ ধরতে বাধা দেয়।

কখনও কখনও ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলার ও নৌকায় হামলা চালায়, জেলেদের মারধর করে এবং লুটপাট চালায়। বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলীয় দুবলারচর সংলগ্ন শ্যালারচর, ছাপড়াখালী, আলোরকোল, মাঝের কিলা, অফিস কিলা এবং নারকেল বাড়িয়ার জেলেপল্লীর আলী হোসেন, জাহাঙ্গীর মাঝি, খালেক মাঝি, বাবুল মাঝি ও লোকমান মাঝিসহ অনেকেই এ ধরণের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন।

তারা বলেন, "গভীর সমুদ্রে মাছ থাকলেও ভারতীয় জেলেদের কারণে তাদের মাছ ধরা ব্যাহত হচ্ছে।" তারা আরো জানান, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকার কাছে হওয়ায় সেখানকার বিপুলসংখ্যক জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে।

কোন কোন ট্রলারে মাছ ধরার অত্যাধুনিক জালসহ আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে। বাংলাদেশের জলসীমায় যে এলাকায় মাছের পরিমাণ বেশি, সাধারণত সেই এলাকায় তারা মাছ শিকার করে। তাদের দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশি জেলেরা ওইসব এলাকায় মাছ শিকার করতে পারেন না।

সাগরে শীতের সময়ই ভারতীয় জেলেদের উৎপাত বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন মংলার মৎস্য ব্যবসায়ী শেখ কামরুজ্জামান জসিম। তবে এবার বর্ষা মৌসুমেও ভারতীয়দের এ উৎপাত চলছে বলে তিনি জানান।

সাগরে মাছ ধরার জেলেদের বরাত দিয়ে তিনি আরো বলেন, "ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ ৫ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে। পাশাপাশি মাছের পোনাও ধরে। তাদের কাছে রয়েছে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) নামক বিশেষ ধরনের যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় জেলেরা যে পথ দিয়ে সাগরে আসে, আবার সে পথ দিয়েই ফিরে যায়।"

সুন্দরবনের মৎস্যজীবী জাবেদ হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় ফিশিং ট্রলার দেশিয় সমুদ্রসীমার প্রায় দেড়শ' কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে মাছ ধরছে। বাংলাদেশের জেলেরা সেখানে গেলে তারা হামলা চালাচ্ছে।

আলম হাওলাদার নামে সাগরের এক জেলে বলেন, ২১ ও ২২ জুলাই সাগরে মাছ শিকারের সময় ভারতীয় এফবি মা গঙ্গা, মা কালী ও মা দুর্গা নামের তিনটিসহ কয়েক'শ ট্রলার দেখা গেছে। এসব ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে লম্বা জাল (প্রস্থে ১০০ হাত), ট্রলিং জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে ইলিশসহ সব ধরনের ছোট-বড় মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলের মৎস্যজীবিদের বৃহৎ সংগঠন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভারতীয় মাছ ধরা ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ইলিশ শিকার করে। এতে বাঁধা দিলে তারা মাইকে হুমকি দিয়ে বাংলাদেশি ট্রলারে হামলা ও জেলেদের ওপর নির্যাতন চালায়।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ট্রলারের জাল ইলিশের জন্য খুবই ভালো ও শক্ত। তাই ভারতীয় জেলেরা ইলিশসহ এসব জাল লুট করে নিয়ে যায়। দু-এক বছর আগে এ ধরনের একটি ঘটনায় ভারতীয় জেলেদের বাধা দিলে পাথরঘাটার এফবি বনফুল ট্রলার ডুবিয়ে দেয় তারা। এতে ওই ট্রলারের মাঝি মো. ইছা প্রাণ হারান।’

পুলিশ সূত্র জানায়, মংলা বন্দর থেকে প্রায় ১শ ৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে এলাকায় গত সোমবার দিনে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অভিযোগে ৩টি ফিসিং ট্রলারসহ ৪২ ভারতীয় জেলেকে আটক করা নৌ বাহিনী। পরে আটক এসব জেলেদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মংলা থানার ওসি বেলায়েত হোসেন জানান, এদেশে ধরা পড়া ভারতীয় জেলের বিরুদ্ধে সাধারণত অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও মাছ চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।

আদালতের একটি সূত্র জানায়, ধরা পড়া বিদেশী জেলেরা আদালতে সাধারণত বঙ্গোপসাগরে সীমারেখা বুঝতে না পেরে ভুল করে বাংলাদেশে প্রবেশের দাবি জানিয়ে অল্প কিছুদিন কারাভোগ করে মুক্তি পেয়ে যায়। তবে দেশীয় জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ জলসীমায় বেশি মাছ পাওয়া যায় তাই ভারতীয় জেলেরা বেশি মাছের আশায় ইচ্ছে করেই এ দেশের জলীমায় অহরহ ঢুকছে আর মাছ লুটে নিচ্ছে।

মংলা কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের অপারেশন অফিসার লেফটেন্যান্ট রাহাতুজ্জামান বলেন, ‘নদী ও সাগর মোহনায় জেলেদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের মূল দায়িত্ব। তবে বাংলাদেশের জলসীমা বা গভীর সাগরে নৌবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বে আছেন। তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় করে ভারতীয় ট্রলারের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’

(একে/এসএফকে/আগস্ট ০৬, ২০১৫)