আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চলতি বছর ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে’র প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের দুঃসহ স্মৃতি এখনও অম্লান নেপালবাসীর মনে। এখনও তাদেরকে রাত কাটাতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে রাস্তায়-ফুটপাতে। দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টারত সরকার ধুকছে অর্থনৈতিক সংকটে। এরই মধ্যে বিজ্ঞানীরা দিলেন ভয়াবহ এক দুঃসংবাদ। সামনে আরো বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে নেপাল ও ভারত।

চলতি বছর ২৫ এপ্রিল নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে একযোগে আঘাত হানে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে কেন্দ্রে এর মাত্রা ছিল ৭.৮। এর ঠিক ১৭ দিনের মাথায় আবারও একবার কেঁপে ওঠে এই অঞ্চল। রিখটার স্কেলে নতুন এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৪। ভারত ও বাংলাদেশে তেমন ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও, নেপাল পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপ ও মৃত্যুপুরীতে। এই দুই ভূমিকম্প ছাড়া আরও সাড়ে তিন শতাধিক পরাঘাত দেশটিকে করে তোলে আরও ভয়ংকর।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, শক্তিশালী দুই ভূমিকম্পের আঘাতে নেপালে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৯ হাজার মানুষের। আট দশকের মধ্যে এবারের ভূমিকম্পেই মৃত্যুর মিছিল এতোটা ব্যাপক। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে আট লাখের বেশি বাড়িঘর ও স্থাপনা আংশিক অথবা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, দেশটির মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২৮ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।

এদিকে, বিজ্ঞানীরা তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখেছেন, এপ্রিলে আঘাত হানা ভূমিকম্পটির মতো বা তার চেয়ে বেশি শক্তির আরও ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে এই অঞ্চলে। মাসিক বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘নেচার জিওসায়েন্স’ ও ‘সায়েন্স’-এ এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনটির রচয়িতা ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধ্যাপক জিন-ফিলিপ্পে আভচ বলেছেন, এই অঞ্চলের ওপর আরও নিবীড় পর্যবেক্ষণ জরুরি। যদি আজ কোনো ভূমিকম্প সেখানে আঘাত হানে, তাহলে তার ফলাফল হবে এপ্রিলের ভূমিকম্পের চেয়েও ভয়াবহ। নেপালের পশ্চিমাঞ্চলেই শুধু নয়, ভারতের উত্তরাঞ্চলে গাঙ্গেয় সমভূমিতেও রয়েছে প্রচুর ঘণবসতি। এর ফলে প্রচুর সংখ্যক মানুষ হতাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূগর্ভে ভারতীয় প্লেট উত্তরে ইউরেশীয় প্লেটের দিকে প্রাকৃতিকভাবে সরছে। বছরে এই সরণের হার গড়ে ২ সেন্টিমিটার। এই দুই প্লেটের সংঘর্ষেই এপ্রিল ও মে মাসের ভূমিকম্প দু’টি সংঘটিত হয়েছে।

তাদের মতে, দশকের পর দশক ধরে এই দুই প্লেটের মধ্যে ‘ফল্ট লাইন’ বা ‘চ্যূতি রেখা’য় শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এই ফল্ট লাইনকে ‘হিমালয়ান থ্রাস্ট ফল্ট’ও বলা হয়। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর খুব কাছেই এটি অবস্থিত। এই অঞ্চলে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেট একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে পরস্পরের মধ্যে ঘর্ষণ ও পারস্পরিক দৃঢ় অবস্থানের কারণে গতিহীনতা ফল্ট লাইনে শক্তি তৈরি করছে। এই শক্তি শুধুমাত্র বড় কোনো ভূমিকম্পের মাধ্যমেই মুক্ত হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, এপ্রিলের ভূমিকম্পে ফল্ট লাইনে সঞ্চিত শক্তির মাত্র কিছু অংশ মুক্ত হতে পেরেছে। বিপুল পরিমাণ শক্তি এখনও সেখানে সঞ্চিত রয়েছে।

অধ্যাপক জিন-ফিলিপ্পে আভচ বলেছেন, য‍দি শক্তি মুক্ত করতে গিয়ে হিমালয় পর্বতমালার সামনে ভূস্তরীয় প্লেট দু’টোর আবদ্ধ সবগুলো এলাকা একত্রে কেঁপে ওঠে, তাহলে সে ভূমিকম্পের ফলাফল হবে ভয়াবহ।

এপ্রিল ও মে মাসের ভূমিকম্পের পর দুই প্লেটের মধ্যে সঞ্চিত শক্তির কিছু অংশ নেপালের পোখারা থেকে ভারতে দিল্লির উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় সরে গেছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এরই মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময়সীমা অতিক্রম করে গেছে। এই অঞ্চল সর্বশেষ বড় রকমের কোনো ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল ১৫০৫ সালে। ধারণা করা হয়, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা সাড়ে ৮ এর চেয়ে বেশি ছিল। এপ্রিলের ভূমিকম্পে মুক্ত হওয়া ও এখনও শিলাস্তরের ফাঁকে অবশিষ্ট থেকে যাওয়া শক্তি গত পাঁচ শতাব্দি ধরে এই অঞ্চলে তৈরি হয়ে সঞ্চিত হচ্ছে।

অধ্যাপক জিন-ফিলিপ্পে আভচ বলেন, এই মুহূর্তে আমরা নেপালের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে দারুণ শঙ্কিত। আমরা মানুষকে ভয় দেখাতে চাই না। কিন্তু ভূস্তরের কোন অঞ্চলে শক্তি সঞ্চিত আছে এবং হচ্ছে, সে অঞ্চলের ব্যাপারে তাদেরকে সাবধান করা জরুরি।

যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড রোথেরি এ গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যের ব্যাপারে বলেন, ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোয় জীবন বাঁচানোর এখন একটাই উপায়। সর্বস্তর ও সব বয়সের মানুষকে দুর্যোগের সময় করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া। সেই সঙ্গে স্কুলভবনসহ বেশ কিছু ভবন এমনভাবে নির্মাণ করা উচিত, যাতে এগুলো কম্পনে ধসে পড়বে না।

(ওএস/এএস/আগস্ট ০৭, ২০১৫)