আনিসুর রহমান আলিফ : আমার বাড়ি যশোর শহরের বারান্দিপাড়া এলাকায়। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম। কাল অফিস খুলবে তাই আজই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হতে হলো। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের কাছে এসে বিশাল এক জ্যামে পড়েছি।

জ্যাম কখন ছাড়বে তা গাড়ির এই লম্বা লাইন দেখে কিছুই ঠাওর করার উপায় নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা কয়েকজন যাত্রী বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকানে ঢুকলাম। যে ভদ্রলোক আমার পাশের সিটে বসে ঢাকা যাচ্ছিলেন তার সাথে আলাপ পরিচয়টা ইতোমধ্যেই বেশ জমে উঠেছে। তিনি চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন,
-যা অবস্থা দেখছি তাতে আজ রাতে গাড়ির চাকা আর ঘুরবে বলে তো মনে হয় না।
আমাদের মধ্যে থেকে দু’একজন তার কথায় সায় দিয়ে বললো,
-আল্লাহই ভালো জানেন। তবে বলা যায় না, জাঁদরেল সার্জেন্ট থাকলে এই জ্যাম ছাড়ানো খুব বেশি মুশকিল হবে না।
আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক চায়ের কাপ থেকে মুখ নামিয়ে বললেন,
-আরে রাখুন। ও দিন গুজার গ্যায়া। জাঁদরেল অফিসাররা চুপসে এখন সব ইয়ে হয়ে গেছে। যেয়ে দেখুন, কোথায় কোন কোণে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সরকারি চাকরি বুঝলেন, সরকারি চাকরি। সবাই তো আর আমাদের মতো কোম্পানিগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় না। সরকারি চাকরিজীবীদের কিসের এতো দায় পড়েছে বলুন?

দেশ যে ডিজিটাল হতে শুরু করেছে তা প্রতিটি চায়ের দোকানে থাকা রঙিন টিভি আর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বাহারি প্রোগ্রাম দেখলেই আন্দাজ করা যায়। ওরা এখন আর আগের মতো বাঁশের মাথায় এান্টেনা খাঁটিয়ে টিভি দেখে না। রিমোট এর বাটন চাপলেই দেশ-বিদেশের সব স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো চোখের সামনে চলে আসে। আমরা যে চায়ের দোকানে বসেছি সেখানে একটা রঙিন টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের ওয়াইল্ড লাইফ নামক একটা প্রোগ্রাম সম্প্রচারিত হচ্ছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের এই প্রোগ্রামটা আমার বেশ লাগে। একটা সিনে দেখাচ্ছে, কতোগুলো গণ্ডার একটি বনের ধারে একটি ডোবার জলের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাদের ঢলে পড়া মোটা চামড়াগুলো সত্যিই দেখার মতো এক বস্তু। ডায়নোসরের জাতভাই বলেই বুঝি ওদের নামকরণ করা হয়েছে রাইনোসরাস। মুখের সামনে ঐ যে প্রকাণ্ড একখানা শিং, ওরে বাপরে ! ওটা দিয়ে ওরা আক্রমণ-আত্মরক্ষা দু-ই করে।

গণ্ডারগুলো দেখেই কী এমন হলো তা বলতে পারি না। পুরোনো একটি স্মৃতি আমার স্মৃতিপটের কোথায় যেন ভেসে উঠলো। স্মৃতিটা খুব সুখকর নয় বলে মনটাও কেমন যেন উদাস হয়ে গেল।
আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক বললেন,
-কী ব্যাপার, কিছু বলছেন না যে? আমি বললাম,
-পুরোনো একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। ভদ্রলোক বললেন,
-একান্ত কোনো স্মৃতি?
-না।
-তাহলে বলে ফেলুন। দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমাদের হাতে এখন অফুরন্ত সময়। আমরা এখন এমন একটা জায়গায় আটকে আছি, যার সীমা-পরিসীমা বলে কোনো কিছু নেই। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করলে সময়টা বেশ কেটে যাবে। নিন নিন, শুরু করুন। অন্যরাও দেখলাম বেশ উৎসাহ দেখিয়ে গল্প শুনতে আগ্রহ জানালো।

সত্যি কথা বলতে কী, ঘটনাটা বলতে আমারও খুব ইচ্ছে করছিলো। তাই আর দেরি না করে শুরু করলাম।
বছর সাতেক আগের কথা। চাকরিতে তখন নতুন জয়েন করেছি। সরকারি চাকরি।
আমার কথায় সবাই একযোগে বলে উঠলো,
-আপনি সরকারি চাকরিও করেছেন?
-হ্যাঁ, আরএইচডি মানে সড়ক ও জনপদ বিভাগে একাউটেন্ট পদে চাকরি।
-আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক জিহ্বায় চুক চুক শব্দ করে বললেন,
-ছাড়লেন কেন? ওটাতো সোনার হরিণ।
-হ্যাঁ সোনার হরিণ বটে। কিন্তু বিশেষ একটা কারণে চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।
আমার প্রথম পোস্টিং হয় রাজবাড়ি জেলায়। অফিসে আমি নতুন লোক তাই ছোট বড় সকলের আদর ভালোবাসা নিয়ে দিনগুলো বেশ কাটছিলো। আমাদের অফিসের যিনি বড়কর্তা, মানে নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেব তিনি সত্যিই চমৎকার লোক। যেমন তার ব্যবহার তেমন তার সততা। এই বিভাগে চাকরি করলে উপরি ইনকাম আছে এটা আমি চাকরিতে ঢোকার আগেই জেনেছিলাম কিন্তু নিজে সৎ থাকবো, কখনও সুদ-ঘুস স্পর্শ করবো না এটা আমার ছেলেবেলার একটা প্রতিজ্ঞা। কলেজ লাইফে আমার এই প্রতিজ্ঞার কথা শুনে বন্ধুরা বাঁকা হেসে বলতো,
-রাখ, রাখ। কতো দেখলাম, চুনো পুঁটি গভীর জলে পড়লে দিশেহারা হয়ে যায় বুঝলি? আজকাল সুদ-ঘুস না খেলে সরকারি ভাত হজম হয় না।

যা হোক আমার চাকরির বয়স ইতোমধ্যে ছয় মাস অতিক্রম করেছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার সুদ-ঘুস স্পর্শ করিনি। হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেবের ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। তিনি মাদারিপুর জেলায় বদলি হয়ে গেছেন। সপ্তাহ ক্ষাণিক বাদে বড়কর্তা সত্যিই আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে ফ্যামিলি সহ মাদারিপুর চলে গেলেন। স্যারের চলে যাওয়াতে মনটা একটু খারাপ হলো। আমার অবস্থা দেখে অন্যান্য কলিগরা বললেন, সরকারি চাকরিতে বদলি হচ্ছে প্রমোশনের মতো একটা ব্যাপার। যার যত বদলি তার তত অভিজ্ঞতা।

দিন সাতেকের মধ্যেই আমাদের নতুন নির্বাহী প্রকৌশলী সাহেব আসলেন। নাম জামিল হায়দার। বেল্টের উপর দিয়ে ঢলে পড়া ভুড়ির উপর চওরা কাঁধ আর তার উপরে থলথলে মাংসল একখানা কালো মুখ। চতুরতার কটু ভাব সে মুখের প্রতিটি রেখায় রেখায় খেলা করে বেড়াচ্ছে। আমাদের সবার সাথে পরিচয় বিনিময় শেষে বড়কর্তা হেডক্লার্ক সাহেবকে একান্তে তার রুমে ডাকলেন। ক্ষাণিক বাদে হেড ক্লার্ক সাহেব মুখে অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। শুনেছি আমাদের হেড ক্লার্ক সাহেব নাকি প্রচন্ড ঘুস খোর ছিলেন। আগের স্যারের সততার কারণে দীর্ঘ একটি বছর তিনি ঘুস খেতে পারেন নি। এখন নতুন স্যার এসেছেন। তিনি ঘুস খান কী খান না তা এখনও কেউ জানে না। তবে খেলে হেড ক্লার্ক সাহেব যে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যা হোক অফিস চলছে। সপ্তাহ খানেক বাদেই বুঝলাম, আমাদের বড়কর্তা ঘুস খান। রাজবাড়ি শহর খুব বেশি বড় নয়। এখানে যারা ঠিকাদারি ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের সকলকেই আমরা মোটামুটি চিনতাম। এদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন মানের কাজ করে বেশি দর নেয় যে ঠিকাদার তার টেন্ডার পাশ হতেই বিষয়টা আমার চোখে ধরা পড়লো। হেড ক্লার্ক সাহেবের সেই উস্ক-খুস্ক চুল ইদানিং তেলে একেবারে জব জব করে। আর করবেই বা না কেন? গোঁজামিলের ফাইলগুলোকে পরিসুদ্ধ করার জন্য মাথাটাকে তো ঠান্ডা রাখা দরকার। ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে শুরু করলাম আমাদের বড়কর্তা ঘুস নিতে কতটা নির্লজ্জ। পঞ্চাশ টাকা দামের একখানা গায়ে মাখা সাবানও তার হাত থেকে রেহাই পায় না। আমি দেখেছি যে বাড়ির কর্তা বদ মেজাজি তার কুকুরটাও হয় রুক্ষ। আমাদের অফিসের চেহারাটা তাই দিনে দিনে পাল্টাতে শুরু করেছে। বড়কর্তা থেকে এমএলএসএস পর্যন্ত সকলের মধ্যেই কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসে গেছে। শুধু অফিস কেন? অফিসের সামনে ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানিও স্যারের দালাল হিসাবে কাজ করে। মাঝে মাঝেই স্যারের রুমে চা দিয়ে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হেসে বলে,
-আগের স্যাররে চা খাওয়াইয়া মজা পাই নাই। রং চা ছাড়া কিচ্ছু খাইতো না। এই স্যারের জিভে স্বাদ আছে। স্যারে মাশাআল্লাহ সবই খায়, হি হি হি।
রাগে গা-টা আমার জ্বলে যায়। এমন বিশ্রীভাবে বেশ্যালয়ের কোনো দালাল-ই হাসতে পারে। আর আমাদের স্যার-ই বা কেমন? এতবড় একজন অফিসার অথচ ইজ্জত সম্মান বলে তার কোনো কিছু নেই! ছিহ্। সরকার এতগুলো টাকা বেতন দিচ্ছে, ফ্যামিলিসহ বসবাস করার জন্য বাংলো দিচ্ছে, চলাচলের জন্য গাড়ি দিচ্ছে তার পরেও কীসের এত প্রয়োজন? বুঝতে পারি এই প্রয়োজনটা শয়তানির, লালসার। একটা ডিপার্টমেন্টে সব লোক ঘুস ঘোর থাকে না। এরকম অল্প কিছু লোকের জন্য আজ গোটা ডিপার্টমেন্টটাই বদনামের মুখে পড়েছে। এইসব যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম হেড ক্লার্ক সাহেব আমার রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে অন্যমনস্ক দেখে বললেন,
-কী? মন-টন খারাপ না কী? বুঝি বুঝি, আপনার নতুন চাকরি, কোনো সমস্যা হলে বলবেন। আরে আমরা আছি না। লজ্জা করে আর কতদিন? আমি বললাম,
-না, কোনো সমস্যা নেই।
-আরে না না, সমস্যা তো থাকবেই। এত অল্প বেতন, বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে আর কী-ইবা হাতে থাকে। একটু বুঝে-শুনে কাজ করলে টাকা-পয়সার সমস্যা হবে না, হি হি হি।

আমি হেড ক্লার্ক সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। চায়ের দোকানির সেই হাসির সাথে এ হাসির কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলাম না।

ওদিকে বড়কর্তা ধীরে ধীরে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। ব্যাপারটা হেড ক্লার্ক সাহেবের গজ-গজানিতে বুঝতে পারলাম। গজগজ করতে করতে আমার রুমে এসে বললেন,
-তিনি যেমন এই অফিসের বড়কর্তা তেমনি আমিও এই অফিসের বড়বাবু। আমাকে সাথে না রেখে কোনো কাজ করে তিনি শান্তি পাবেন? কখনও না।

হেড ক্লার্ক সাহেবের এমন আচরণে আমার ভীষণ হাসি পেল। রাস্তার মদ্যপের কান্ড কীর্তি দেখে সাধারণ মানুষ যেমন আনন্দ পায় তেমনি হেডক্লার্ক সাহেবের সাইকো রোগীর মতো এমন আচরণ দেখে সত্যিই মজা লাগছে। হেড ক্লার্ক সাহেবের দুর্দিন অবশ্য বেশি দিন থাকলো না। বড়কর্তা হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন তাই চায়ের দোকানদারকে বাদ দিয়ে অফিসের অন্য অফিসারদেরকে তিনি বিভিন্ন পার্সেন্টেজ এ নিযুক্ত করলেন। আগের স্যারের সময়ে টেবিলে যাদেরকে নীতি কথার ঝড় তুলতে দেখেছি এখন তাদেরকেই দেখছি মিচকে শয়তানের মুখোস পড়ে আত্মসম্মানে পাঠা বলি দিয়ে সমানে ঘুস নিচ্ছে। সমস্ত অফিসের এই যখন অবস্থা তখন আমি একলা আদমি পড়ে গেলাম বিরাট যন্ত্রণায়। এই নর পশুগুলোর মধ্যে নিজেকে কেমন যেন একঘরে-একঘরে মনে হয়। আমি অফিসের একাউনটেন্ট তাই সরকারি টাকা পয়সার বিষয়গুলো আমার হাতেই থাকে। আমাকে বাগে আনতে না পারলে ওদের চলবে কেন? হেড ক্লার্ক সাহেব তাই আমার পিছনে লেগেই রইলেন। নানাভাবে, নানাকায়দায় তিনি আমাকে তাদের দলে ভেড়াবার চেষ্টা করতে থাকলেন। একদিন বিকালে আমার রুমে এসে বললেন,
-শোনেন হাসান সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলি। এই যে আপনি অফিস আওয়ারের শেষেও কাজ করে যাচ্ছেন এর জন্য সরকার কি আপনাকে কোনো ওভার টাইম দেয়? দেয় না। সরকার যা বেতন দেয় তা দিয়ে আমার বড় ছেলের পড়াশোনার খরচই তো হয় না। সংসার কী ভাবে চলে তার খবর আমি ছাড়া আর কে নেয় বলুন? আগে বুঝিনি, বুঝলে ব্যাংক ভর্তি টাকা থাকতো। আপনি নতুন লোক এখন টাকা ধরতে না পারলে আর কবে ধরবেন।

হেড ক্লার্ক সাহেব আমার সিনিয়র তাই তাকে মুখে কিছু বলতে পারি না কিন্তু মনে মনে উত্তরটা ঠিকই বাজতে থাকে। সরকারি বেতনে চলে না তো চাকরি করতে এসেছেন কেন? রাতের অন্ধকারে দা-ছুরি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন গিয়ে।

আমার চাকরির বয়স প্রায় দুই বছর হতে চললো। এখনও ঘুষ কীভাবে নিতে হয় তা শিখতে পারিনি। এটা আমার দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য বলতে পারি না তবে এক কপর্দক ঘুসও আমি আমার পকেটে তুলি নি। ওদিকে বড়কর্তার ভুড়ি, কাঁধ আর মাংসল মুখখানা আরো ভড়াট হয়েছে। একদিন একটি ফাইল স্যারের রুমে সই করাতে গিয়ে দেখি আট-দশ বছরের একটি মেয়ে বসে আছে। বুঝলাম স্যারের মেয়ে। ফাইল সই করাচ্ছি এমন সময় একজন ঠিকাদার রুমে ঢুকলো। কোনো আদব কায়দা না দেখিয়ে সরাসরি স্যারের টেবিলে দু’টো পাঁচশো টাকার বান্ডিল নামিয়ে দিয়ে বললো,
-স্যার, আর পারবো না। এটা রেখে আমার কাজটা এবারের মতো করে দিন।

স্যারের মেয়ে একবার টাকার দিকে তাকাচ্ছে পরক্ষণেই স্যারের দিকে, একবার আমার দিকে একবার ঠিকাদার লোকটার দিকে। চোখে মুখে তার রীতিমতো অপ্রস্তুত লজ্জার ছাঁপ। বয়স আট-দশ বছর হলে কী হবে, ডিজিটাল যুগ, এরা সব জানে।

স্যার টাকাগুলো নিয়ে ড্রয়ারে রাখতে রাখতে ঠিকাদারকে বললেন,
-আর কিছু না দিলে তো হবে না। উপর মহলে যারা বসে আছেন তাদের দিয়ে কী-বা থাকবে বলেন? লোকটা তার পকেট থেকে আরো কিছু খুচরা টাকা বের করে স্যারের হাতে দিয়ে বললেন,
-এবারের মতো কাজটা করে দিন স্যার। সামনের বার যা বলবেন তাই হবে।
স্যারের মেয়েটি এখনও ঠিকাদার লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে তার ঘৃণা মিশ্রিত কৌতূহলের ঢেউ জেগেছে। হঠাৎ আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বললো,
-বাবা তুমি কি ঘুষ খাও? এটা কি ঘুসের টাকা। মেয়ের হঠাৎ এমন আক্রমণে স্যার কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। মেয়ে যে এমন একটা কথা বলবে তা কে ভেবেছিলো। স্যার আতুমাতু করে বললেন,
-না না, এটা অফিসের টাকা। মেয়েটি গাল ফুলিয়ে বললো,
-আমি ঠিক বুঝেছি, ওটা ঘুষের টাকা। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না বাবা, আমি বাসায় যাবো।
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-আচ্ছা ঠিক আছে মামনি, তোমার আঙ্কেল তোমাকে পৌঁছে দেবে।
মেয়েটির হাত ধরে নিচে নেমে এলাম। কম্পাউন্ডে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের নামতে দেখেই ড্রাইভার পেছনের দরজা খুলে দিলো। মেয়েটি গাড়িতে উঠলো না। আমাকে বললো,
-আঙ্কেল, তুমি কি আমাকে রিক্সায় করে বাসায় দিয়ে আসতে পারবে?
-কেন পারবো না।
একটা রিক্সা ডেকে আমরা রওনা হলাম। অবস্থাটা স্বাভাবিক করতে বললাম,
-মামনি তোমার নাম কী?
-শিউলি।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম কথা বলার কোনো উৎসাহ ওর মধ্যে নেই। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। অফিস থেকে স্যারের বাংলো খুব বেশি দূরে নয়, মিনিট পাঁচেকের পথ। গেট পেরিয়ে বাংলোর সামনে এসে রিক্সা থামলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি শুধু বললো,
-আমি জানি বাবা ঘুস খায়। ঘুস খাওয়া ভালো না, তাইনা আঙ্কেল?
কী বলবো বুঝতে পারছি না। বললাম,
-হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো, ঘুষ খাওয়া ভালো না।
-তাহলে বাবা ঘুষ খায় কেন? বাবা ভালো না, বাবা ঘুস খোর, বাবা ভালো না।
আমি বুঝতে পারছি আজ ওর ঐ ছোট্ট মনটার ভেতর কী ঘটে চলেছে। প্রতিটি সন্তানের কাছে তার বাবা হচ্ছেন একজন সুপার হিরো। সেই সুপার হিরো যখন ভিলেন হিসাবে আর্বিভূত হয় তখন সন্তানদের মন এক নিমেশেই ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়। নিজের বাবার এহেনু পরিচয়ে তার ছোট্ট হৃদয়টা দুমড়ে মুচরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই।
অফিসে ফিরতেই স্যার আমাকে ডেকে বললেন,
-ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে? আমি বললাম,
-মেয়ে বড় হচ্ছে, কিছুটাতো বুঝেছে নিশ্চই। স্যার আমি আপনার অধীনস্থ কর্মচারী, আপনাকে জ্ঞান দেওয়াটা আমার জন্য শোভা পায় না। তবুও বলবো এই বিষয়টার কারণে আজ ওর মনটা একেবারে ভেঙে চুড়ে গেছে।

বরিশালে বদলি হয়ে এসেছি প্রায় দুই মাস হলো। এখানে দুই মাস চাকরি করে যা বুঝেছি তাতে রাজবাড়ির চেয়ে এখানকার অবস্থা আরো খারাপ। বরিশাল নিচু এলাকা, তাই প্রতিবছরই বন্যার পানিতে রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে যায়। ফলে এখানে কাজ হয় প্রচুর। আর যত কাজ, তত ঘুস। আমি ঘুস নেই না, তাই অফিসের প্রত্যেকে আমার দিকে কেমন যেন বাঁকা চোখে তাকায়। তাকাক, রাতে আমার মতো নিশ্চিন্তে বুকে হাত রেখে ওরা নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারে না।

বরিশালে বদলির বয়স যখন এক বছর ছুঁই ছুঁই করছে তখন বরিশালের সুপারিনটেনডেন্ট বদলি হয়ে গেলেন। তার পরিবর্তে নতুন সুপারিনটেনডেন্ট এলেন। নতুন স্যারকে দেখে আমার চোখ তো একেবারে ছানাবড়া হয়ে যাবার যোগার। জামিল সাহেব, প্রমোশন নিয়ে সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছেন। আমাকে দেখে বললেন,
-কী হাসান সাহেব, কেমন চলছে? বিয়ে করেছেন? না কি এখনও কুমার? আমি বললাম,
-না স্যার, এখনও হয়ে ওঠে নি।
-আগের মতোই আছেন তাহলে। বিয়েটা করে ফেলেন। এতো কীসের অপেক্ষা?

কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, স্যারের প্রোমোশনটা শুধু পদের বেলাতেই ঘটেনি। ঘুষের বেলাতেও তিনি প্রোমোশন পেয়েছেন। ঘুসের আকারটা এখন আর সেই লক্ষের ঘরে বসে নেই, ওটা এখন কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে। স্যারের মেয়েটার কথা মনে পড়লো। এখন সে হয়তো আরো একটু বড় হয়েছে। হয়তো জগৎ সংসারের নির্লজ্জতাকে মাথা পেতে মেনেও নিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এই জগতে কতো কিছুর পরিবর্তন ঘটে, শুধু একজনের কোনো পরিবর্তন নেই। স্পষ্ট মনে আছে, তখন রমজান মাস। বাংলাদেশে রমজান মাসে জাঁদরেল ঘুষখোররাও ঘুষ খায় না। কিন্তু আমাদের স্যার তো আর যেন-তেন ঘুষখোর নন। সারাদিন কোনো খাবার না খেয়ে তিনি দিব্যি রোজা রাখতে পারবেন, কিন্তু ঘুষ? উহু, ওটা তিনি ছাড়তে পারবেন না। রোজার সময়, মানে ঈদের আগে রাস্তা-ঘাটে বেশ কাজ হয়। আর কাজ মানেই টাকা। আমি খেয়াল করেছি রমজান মাসে স্যারের ঘুস খাওয়াটা যেন আরো এক ডিগ্রি বেড়ে যায়।

একদিন স্যারের রুমে কিছু ফাইল সই করাতে ঢুকেছি। আমাকে দেখে স্যার বললেন,
-মেয়েটার খুব জ্বর হয়েছে। এদিকে অফিসে কাজের এত চাপ, কী যে করি।
আমি জানি সারের ফ্যামিলি তখনও রাজবাড়িতে থাকে। স্যারের ছেলে রাজবাড়ি’র একটি স্কুলে পড়ে, তাই ফ্যামিলিকে বরিশালে এখনও আনতে পারেন নি। স্যার বললেন,
-হাসান, তুমি তো রাজবাড়িতে আমার বাংলো চিনতে। বাংলোর পাশেই একটি দোতলা বাড়িতে ওরা আছে। তোমাকে যদি একটা দায়িত্ব দিই, তুমি কি করবে? আমি বললাম,
-কী দায়িত্ব স্যার?
-তুমি যদি একবার ওখানে যাও তো খুব উপকার হয়। মনে মনে ভাবলাম কীসের উপকার হয় তা তো আমি বুঝতেই পারছি। স্যার ফোনে ম্যাডামের সাথে কন্ট্যাক করে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-নাও কথা বলো। ওপাশ থেকে ম্যাডামের গলা শুনলাম।
-কে, হাসান সাহেব?
-জ্বি ম্যাডাম।
-প্লিজ আপনি একটু আসুন। আমার মেয়ের ভীষণ জ্বর। আপনার স্যারকে তো চেনেন। মেয়ের এত জ্বর অথচ টাকার নেশায় সে আসতে পারবে না। আপনি আমার ভাইয়ের মতো। আমি একা মানুষ কী ভাবে কী করি কিছুই বুঝতে পারছি না। ম্যাডামের অনুরোধটা কেন যেন ফেলতে পারলাম না।
কী আর করা। ভাই বলে যখন অনুরোধ করেছে। দুপুরেই রওনা হলাম।

রাজবাড়ি বাসস্টান্ডে নেমে মেয়েটার জন্য কিছু ফল কিনলাম। বাসায় যেয়ে তার মাথায় হাত রেখে বুঝলাম, সত্যিই প্রচণ্ড জ্বর। ম্যাডাম বললেন,
-মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। কিন্তু এবার কেন জানি জ্বরটা সারছেই না। সাত-আট দিন হয়ে গেলো জ্বরটা একভাবেই রয়েছে। নিয়মিত ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছে কিন্তু কোনো ভাবেই জ্বরটা কমছে না। আমি বললাম,
-কিছু কি খাচ্ছে?
-নাহ্, কিছুই খাচ্ছে না। আমি একটা কমলা ছিলে তার মুখে দিলাম। আমি যে এসেছি জ্বরের ঘোরে এতক্ষণ সে বুঝতেই পারেনি। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আঙ্কেল কেমন আছো? কখন এসেছো? বললাম,
-এইতো কিছুক্ষণ আগে। শুনলাম তুমি নাকি কিছুই খাচ্ছ না। এই কমলাটা একটু খাও। মেয়েটি বললো,
-তোমার টাকা দিয়ে কিনেছো?
-হ্যাঁ মামনি। কমলাটা মুখে নিয়ে বললো,
-খুব মিষ্টি। এর স্বাদই আলাদা। বাবার টাকায় কেনা কোনো কিছুই আমার ভালো লাগে না। বাবার টাকা ঘুষের টাকা।
-এখন কথা বলো না, ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকো।
মেয়েটি হয়তো আবার জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে মনে ভাবলাম, স্যারের ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারটা সে এখনও মনে রেখেছে! আমাকে নীরব থাকতে দেখে ম্যাডাম বললেন,
গত এক বছর হয়ে গেলো খাওয়া দাওয়ার উপর ওর অনিহা প্রচণ্ড বেড়েছে। ডাক্তার দেখিয়েছি অনেক কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। দেখছেন না শুকিয়ে কী হয়ে গেছে?
গত এক বছরের কথা শুনে মনের মধ্যে আমার খঁচ করে উঠলো। তাহলে কী সেদিন থেকেই ওর অসুখ শুরু হয়েছে ! মনের অসুখ ধীরে ধীরে আজ শারীরিক অসুখে পরিণত হয়েছে ! নাহ্, মেয়েটিকে এভাবে অবহেলা করলে চলবে না। কাল সকালেই ওকে ভালো ডাক্তার দেখাবো। প্রয়োজন হলে ঢাকায় নিয়ে যাবো। ওমন ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে চোখের সামনে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে! নাহ, কালই ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাতে গেস্ট রুমে আমার শোয়ার ব্যবস্থা হলো। বরিশাল থেকে বাস জার্নি করে এসেছি তাই চোখ বেয়ে ঘুম নামলো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ কীসের শোরগোলে ঘুমটা ভাঙে গেলো। বুঝলাম, ড্রাইভার ডাকছে,
-স্যার, শিগগির আসেন, আপামনির অবস্থা ভালো না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দেড়টা। তাড়াতাড়ি উঠে দোতলায় শিউলির ঘরে গেলাম। দেখলাম মেয়েটির মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। হাত পা গুটিয়ে গেছে। ভাবগতি মোটেও ভালো মনে হলো না। আমি এক মুহূর্তও দেরি না করে তৎক্ষণাৎ শিউলিকে রাজবাড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। রাজবাড়ি হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার মেয়েটিকে দেখেই বললো,
-অবস্থা ভালো নয়, আপনারা একে এখনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
আমাদের গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে চলছে। তারপরেও আমি ড্রাইভারকে বললাম,
-আরো জোরে চালাও। জানিনা আমার বুকের মধ্যে কীসের যেন একটা শঙ্কা কাজ করছিলো। ভাবলাম বিষয়টা স্যারকে জানানো দরকার। স্যারের সেল ফোনে ট্রাই করলাম কিন্তু ফোন বন্ধ। বাসার টেলিফোনে ট্রাই করতে ক্ষাণিক বাদে ওপাশ থেকে সারা এলো। কেয়ারটেকার ফোন ধরেছে। আমি পরিচয় দিয়ে বললাম,
-জলদি স্যারকে দাও, স্যারের মেয়ের অবস্থা ভালো না।
ক্ষাণিক বাদে ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে স্যারের গলা শুনতে পেলাম। ঘুষের সাথে তিনি যে মদও ধরেছেন কণ্ঠ শুনে সেটা বুঝতে বাকী রইলো না। মধ্য রাতের একজন মদ্যপকে জরুরি কোনো কিছু বলা আর ঘোড়ার ঘাস কাটা সমান কথা। তবুও বললাম,
-স্যার আপনার মেয়ে ভীষণ অসুস্থ, আমরা ওকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি এখনি চলে আসুন। ওপাশ থেকে স্যার বললেন,
-ভালো ভাবে শোনা যাচ্ছে না, আবার বলো। আমি আবার বললাম। স্যার বললেন,
-একটু ম্যানেজ করো হাসান। আমি কাল আসছি। বলে ফোনটা কেটে দিলেন।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে মেয়েটির অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো। কর্তব্যরত ডাক্তার তখনি শিউলিকে আইসিইউ তে নিয়ে গেলো। দ্রুত কয়েকটি পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, কালো জ্বর হয়েছে। আপনারা এতোদিনে বিষয়টি বুঝতে পারেন নি ! অনেক দেরি করে ফেলেছেন। ব্রেইন হেমারেজ হয়েছে, কিডনির অবস্থাও ভালো না। দেখছি কী করা যায়। ডাক্তারের কথা শুনে ম্যাডাম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। রাতটা কাটলো খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে। সকালের দিকে দেখলাম নার্সরা আইসিইউ এর দরজা দিয়ে ব্যস্ত ভাবে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। ম্যাডাম বললেন,
-কী হয়েছে? ওরা, ওরা ওমন করছে কেন? আমি বললাম,
-দেখছি।
-আইসিইউ এর সামনে যেতেই দেখলাম ভেতর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসছেন। আমাকে দেখে বললেন,
-আপনি মেয়েটির কী হন? আমি বললাম,
-তেমন কিছু না। আমার বসের মেয়ে। বস কাজের জন্য আসতে পারেন নি, তাই আমাকে পাঠিয়েছেন। ডাক্তার বললেন,
-দেখুন, অনেক দেরি করে ফেলেছেন। যদি আরো দু’-একদিন আগে আনা যেত তাহলে হয়তো কিছু করা সম্ভব হতো। সরি, সি ইজ ডেড।
আমি আইসিইউতে ঢুকলাম। বাইরে ম্যাডামের চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিছানায় নিথর পড়ে আছে কঁচি একটি প্রাণের খোলস। প্রচণ্ড কোনো যন্ত্রণায় আঙ্গুলগুলো তার এখনও কুকড়ে মুঠোবদ্ধ হয়ে আছে। আঙ্গুলের দিকে ভালোকরে লক্ষ করতে বুঝলাম, বুড়ো আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে কাগজের মতো কী একটা বের হয়ে আছে। মুঠো খুলে দেখলাম, ভাঁজ করা একটা কাগজ। ওটা স্যারের একটি ছবি। ছবিটার উপর কালো কালি দিয়ে বেশ কিছু ক্রস দাগ টানা হয়েছে। ইস্, কতটা কষ্ট নিয়ে যে সে মারা গেছে তা যদি কেউ উপলব্ধি করতে পারতো !

শিউলি এই দুনিয়ায় আর নেই। ব্যাপারটা স্যারকে জানানোর জন্য ফোন করলাম কিন্তু তার ফোন তখনও বন্ধ। বেলা নয়টার দিকেও তার ফোন বন্ধ পেয়ে অফিসের হেডক্লার্ক সাহেবকে ফোন করলাম। সমস্ত ব্যাপারটা তাকে জানালাম। তিনি বললেন, তিনি এখনি স্যারের বাসায় যাবেন। বেলা এগারোটার দিকে স্যার আমাকে ফোন করে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন,
-দুপুরে বড় রাস্তার টেন্ডার রয়েছে। ওটা শেষ করেই আমি আসছি। তুমি একটু ম্যানেজ করো। আমার আর কথা বলার কোনো মেজাজ ছিলো না। ম্যাডাম কে বললাম স্যার আসতে পারবেন না। সেই ভোর থেকে একটানা কাঁদতে কাঁদতে ম্যাডাম নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দুই চোখের কোণা দিয়ে শুধু অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। দারুণ শোকে কথা বলার কোনো ভাষা তার আর ছিলো না, তবুও অনেক কষ্টে আমাকে শুধু বললেন,
-আমার মেয়ের কবরে তার দেওয়া মাটি যেন না পড়ে। আপনি জলদি ব্যবস্থা করুন।

সেদিন দুপুরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছিলো। শিউলির মৃতদেহ খাটিয়ার উপর শোয়ানো হয়েছে। আমরা কয়েকজন ছোট্ট শিউলির খাটিয়াটি কাঁধে বয়ে আলিপুর কবরস্থানের গভীর থেকে গভীরে নিয়ে চললাম। কোথাও বৃষ্টি বিজরিত আকাশ, কোথাও গাছের পাতা ছুঁয়ে বারিধারা ঝড়ে পড়ছিলো তার ছোট্ট দেহটিতে।

(এআরএ/পি/অাগস্ট ২৩, ২০১৫)