আজ লোহাগড়ার ইতনা গণহত্যা দিবস
লোহাগড়া (নড়াইল)প্রতিনিধি : নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামের ৭১র ২৩ মে একটি ভয়াল দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক-হানাদার বাহিনী লোহাগড়া উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ইতনা গ্রামে একের পর এক ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশুসহ হত্যা করে হিরু মাস্টার, সফি উদ্দিন মোল্যা, তবি শেখ, হাদি সিকদার, নালু খাঁ সহ ৩৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। আর এ সব নিহতদের লাশ ঘর-বাড়ির জলন্ত আগুনে ফেলে দিয়ে উল্লাস করে পিশাচেরা।
মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়া উপজেলার মধুমতি নদী তীরবর্তী পাশাপাশি দুই গ্রাম ইতনা ও চরভাট পাড়া। এই দুই গ্রামে বসেই মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমনের নানা পরিকল্পনা করতো। ভৌগলিক ও কৌশল গত কারণে আশ-পাশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এই দুই গ্রামে অবস্থান করে পাক-বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাতেন।
পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান আঁচ করতে পেরে ১৯৭১ সালের ২২শে মে দুপুরে চরভাট পাড়া গ্রামে প্রবেশ করে নিরীহ মানুষজনের ওপর হামলা-নির্যাতন শুরু করে। এ সময়ে মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং হানাদার বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় যুদ্ধ। প্রায় দুঘন্টা ব্যাপি যুদ্ধে ৪ জন পাক সেনা ও ১৪ মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এক পর্যায়ে পাক-সেনার পিছু হটার সময় ইতনা গ্রামের অনিল কাপালি নামে একজন সাহসী ব্যক্তি এক পাক-সেনার কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পাশের মধুমতি নদীতে ফেলে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
এ ঘটনার পর ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পের পাক হানাদার বাহিনী হিংস্র রুপ ধারণ করে। তারা চরভাট পাড়া গ্রামের অনিল কাপালিকে খুঁজতে থাকে। তখন প্রাণের ভয়ে চরভাট পাড়ার মানুষজন জানিয়ে দেয়, অনিল কাপালির বাড়ি মধুমতি নদীর পূর্ব পাড়ের ইতনা গ্রামে।
অনিল কাপালিকে ধরার জন্য পাক বাহিনী গানবোট করে ৭১ সালের ২৩ মে ভোরে ফজরের আজানের সময় ইতনা গ্রামে ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা চালায়। গণহত্যায় শিশু সহ ৩৯ জন নারী-পুরুষ হত্যার শিকার হয়। ২৩ মে ইতনা গ্রাম প্রেত পুরীতে পরিণত হয়। নিহতদের কবর দেওয়ার মত কোন লোক ইতনা গ্রামে ছিল না।
পরবর্তীতে কবর দেবার সকল নিয়ম কানুন ভঙ্গ করে নিহতদের নিকট আত্মীয়-স্বজনেরা ৩৯ জনকে গ্রামেই গণকবর দিয়ে প্রাণ ভয়ে অন্যত্র পালিয়ে যান। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায় ১৯৭১ সালে ২৩ মে ইতনা গ্রামে সংগঠিত গণহত্যার ইতিহাস অবিস্মরনীয় ঘটনা।
১৯৯৪ সালের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ২৩ মের বীর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ইতনা গণ গ্রন্থাগারের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক ফিরোজ আহম্মদের উদ্যোগে ইতনা গ্রামের দুটি গুরুত্ব পূর্ণ সড়কের পাশে গণহত্যায় নিহতদের নামের তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ২৩ মে ইতনা গণ গ্রন্থাগারের উদ্যোগে ইতনা গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবার গুলোর সদস্যরা মানবেতর ভাবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে আজ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি ভাবে কোন স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয় নাই। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না ৭১র সালের ২৩ মে ইতনার গণহত্যার ইতিহাস। এ বছরও ৭১র ২৩ মে গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে ইতনা গণ গ্রন্থাগারের উদ্যোগে শুক্রবার দিন ব্যাপী নানা কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে।
(আরএম/জেএ/মে ২৩, ২০১৪)