কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : মৃত ভেবে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কলাপাড়া হাসপাতালের সামনে ফেলে রাখা গৃহবধু কুলসুম বেগমের (২১) গত ১৬ ঘন্টায়ও জ্ঞান ফেরেনি। নির্মম নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে সে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।

গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১ টায় শ্বশুড় বাড়ির লোকজন এক সন্তানের জননী গৃহবধূকে হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে গৃহবধূর স্বজনরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। নির্মম নির্যাতন শেষে গৃহবধুকে কীটনাশক খাইয়ে হত্যার চেষ্টা করায় ডাক্তার তার পাকস্থলী ওয়াশ করলেও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত তার জ্ঞান ফেরেনি।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হোসনপুর গ্রামে স্বামী রিয়াজ হাওলাদার মোটরসাইকেল কেনার টাকা চেয়ে না পেয়ে গৃহবধূর উপর এ বর্বর নির্যাতন চালায়।

কলাপাড়া হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় নির্মম নির্যাতনে গৃহবধূর ঠোট ও নাক ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। মুখমন্ডলে ঘুষি ও লাঠির আঘাতে গাল আলুর মতো ফুলে উঠেছে। ঘুষির আঘাতে ডান চোখে রক্ত জমাট হয়ে গেছে। কামড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে কাঁধ ও পিঠ। রান্নার কাঠ (লাকড়ি) দিয়ে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করায় সারা শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। নির্মম নির্যাতনে অবশ হয়ে গেছে হাত-পা। পাষন্ড স্বামীর এই বর্বর নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন দেখে হাসপাতালের অন্য রোগীরা স্বজনরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।

কুলসুমের খালা শিল্পী বেগম জানান, বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে সাত মাসের শিশু ঈসাকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তরকারি রান্না করছিলো কুলসুম। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ঈসা কান্না করলে স্বামী রিয়াজকে ছেলের কান্না থামাতে বলে। কিন্তু সে ছেলের কাছে না যাওয়ায় দু’জনের মধ্যে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে শুরু হয় রিয়াজের বর্বরতা।

তিনি বলেন, রান্নার জন্য রাখা লাকড়ি দিয়ে সারা শরীর পেটানো হয়। কামড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয় কাঁধ ও পিঠ। এলোপাতাড়ি ঘুষিতে ঠোট ফেঁটে রক্ত পরলেও তার নির্যাতন থামেনি। এক পর্যায়ে লাকড়ি ভেঙ্গে গেলে কিল-ঘুষি মেরে গোটা মুখমন্ডল ফুলিয়ে দেয়া হয়। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে চলে এই নির্যাতন।

এক পর্যায়ে বসার পিড়ি ও চৌকি দিয়ে মাথায় আঘাত করা হলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কুলসুম। কুলসুম মারা গেছে ভেবে তার মুখে ঘরে থাকা কীটনাশক ঢেলে আত্মহত্যার নাটক সাজানোর চেষ্টা করা হয়। হঠাৎ গৃহবধুর দেবর মিরাজ ঘরে এসে এ দৃশ্য দেখে স্থানীয়দের সহায়তায় কুলসুমকে উদ্ধার করে সে। কিন্তু হাসপাতালের গেটে আনার পর গৃহবধুর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে মারা গেছে ভেবে ভয়ে হাসপাতাল গেট থেকেই পালিয়ে যায় মিরাজ।

পরবর্তীতে গ্রামবাসী কুলসুমের স্বজনদের খবর দিলে তারা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। খবর পেয়ে রাতেই কলাপাড়া থানা পুলিশ অসুস্থ গৃহবধুকে হাসপাতালে গিয়ে তার খোঁজ নেন।

গৃহবধুর মামা মিরাজ হাওলাদার জানান, কুলসুমের বাবার কাছে একটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা চেয়েছিলো রিয়াজ। কিন্তু তার পরিবারের পক্ষে এ টাকা দিতে পারবে না বলে জানালে এভাবে নির্যাতন চালিয়ে মৃত ভেবে হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। তারা রাতে খবর না পেলে হয়তো বিনা চিকিৎসায় তার ভাগনী মারা যেত।

কুলসুমের স্বজনরা জানান, প্রায় চার বছর আগে কুলসুমের বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে রিয়াজকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও গৃহবধুর গলায় ও কানের সোনার জিনিস ছাড়াও লেপ-তোষক বিভিন্ন মালামাল দেয়া হয়।

গত ছয় মাস আগে মেয়ের সুখের জন্য কুলসুমের কাঠ মিস্ত্রি পিতা বজলু তালুকদার নিজে একটি ঘর তুলে দেন। কিন্তু হঠাৎ করে বজলু তালুকদার অসুস্থ্য হয়ে পড়ে এখন শয্যাশায়ী। এ কারনে কোন কাজ করতে না পারায় জামাইয়ের মোটরসাইকেল কেনার টাকা দিতে অপরাগত প্রকাশ করেন।

কলাপাড়া হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শাহআলম হুসাম জানান, গৃহবধুর পাকস্থলীতে অজ্ঞাত বিষ পাওয়া গেছে। তাছাড়া তার সারা শরীরে আঘাত রয়েছে। সে এখনও শংঙ্কামুক্ত নন।

কলাপাড়া থানা পুলিশ জানায, গৃহবধূ নির্যাতনের ঘটনায় এখনও থানায় মামলা হয়নি। তবে ঘটনা শোনার পর রাতেই পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে নির্যাতনের শিকার গৃহবধুর খোঁজ নিয়েছেন। মামলা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(এমকেআর/এএস/অক্টোবর ২৩, ২০১৫)