বান্দরবান প্রিতিনিধ : ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি দিবস আজ ২রা ডিসেম্বর। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বান্দরবানে। এ উপলক্ষে জেলা পরিষদ ও সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় রাজার মাঠ থেকে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় রাজার মাঠে এসে সমাপ্ত হয়। পরে সেনা রিজিয়নের আয়োজনে দিনব্যাপী ফ্রি চিকিৎসা শিবির উদ্বোধন করা হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। এতে অন্যান্যের মধ্যে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, বান্দরবান সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ একে ফজলুল হক প্রমুখ।

এতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলেন, পার্বত্য এলাকার মানুষ শান্তি চায়, কেউ অশান্তি চায় না। কিছু কিছু ধারা এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে। তা অতিশিগ্রই বাস্তবায়িত হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। এ বিষয়ে প্রধান মন্ত্রীর কাছে দাবী জানানো হয়েছে। সন্ধ্যায় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি সাংস্কৃতিক ইনিষ্টিটিউট এর উদ্যোগে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এদিকে শান্তি চুক্তি ১৮ তম বর্ষপুর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতি বিকেলে শহরে র‌্যালী ও দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা করেছে। এতে দলীয় নেতাকর্মীরা শান্তি চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবী এবং চুক্তি পরিপন্থি কর্মকান্ড থেকে সরকারকে বিরত থাকার আহবান জানান।

অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে শান্ত করতে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর তৎকালিন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সভাপতি ও গেরিলা নেতা সন্তু লারমার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী এবং নীরিহ উপজাতিরা স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশা করলেও মুলত চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষর মতানৈক্য এবং আদিপত্যর লড়াইয়ের কারণে অশান্তই থেকে যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম। চুক্তির পর সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসহ মৌলিক খাতের ব্যাপক উন্নয়ন হলেও অস্ত্রের ঝনঝনানিতে সংঘাতময় পরিস্থিতি’র কারনে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৮ বছর পা পড়লেও শান্তির সুবাতাস থেকে বঞ্চিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী। তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী জনপদ গুলো শাসন করছে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে শান্তির বদলে ঠাই করে নিয়েছে অশান্তি আর অনিশ্চয়তা। অত্যাধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ী বিভিন্ন সংগঠন। সরকারী ভাবে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে এবং সন্ত্রাসীদের আস্তানা ধ্বংস করে অত্যাধুনিক কিছু অস্ত্র উদ্ধার করলেও সন্ত্রাস দমনে তা একেবারে অপ্রতুল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্বাধীন জুম ল্যান্ড গঠনের দাবীতে ১৯৭৩ সালে আন্দোলনের ডাক দেয় তৎকালীন উপজাতি জনগোষ্টির নেতা প্রায়াত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা। তিনি গঠন করেন শান্তি বাহিনী নামে একটি শসন্ত্র দল। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শান্তির বাহিনীর হাতে ত্রিশ হাজারেরও বেশী সরকারী-বেসরকারী চাকুরীজীবিসহ নীরিহ পাহাড়ী-বাঙ্গালী নারী পুরুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় । এই পরিস্থিতি উত্তোরণে দফায় দফায় আলোচনার পর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
একদিকে সশস্ত্র অপরদিকে রাজনৈতিক আন্দোলন পার্বত্য পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার ভক্ত ও সমর্থকরা চায় চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকারীভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের ধীর গতিতে তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। ইউপিডিএফ চায় পুর্ণ স্বায়ত্বশাসন। তারা মনে করেন চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ী সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের কোন পরিবর্তন হবে না। অপরদিকে বাঙ্গালী সংগঠন গুলো চাইছে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজী দমনে কঠোর পদক্ষেপ।
জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ক্যবামং মারমা জানান, শান্তিচুক্তির ধীরগতির কারণে চলতি বছরের ১লা মে থেকে অসহযোগ আন্দোলন চলে আসছে। চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন অব্যহত আছে এবং কঠোর আন্দোলনের সম্ভাবনা আছে।
ইউপিডিএফ’র আহবায়ক ছোটন কান্তি তংচ্যঙ্গ্যা বলেন, শান্তি চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। আমরা পুর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবী করছি। তার অর্থ হচ্ছে অর্থ, পররাষ্ট্র, ভারী শিল্প এবং প্রতিরক্ষা এই চারটি বিভাগ ব্যতীত বাকি সবগুলো বিভাগ হস্তান্তর করতে হবে। জাতিসত্তার স্বীকৃতিসহ সাংবিধানিক গ্যারান্টি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যা লঘু জনগন তাদের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
সমঅধিকার আন্দোলন’র সভাপতি সেলিম আহমেদ চৌধুরী জানান, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় চুক্তির সকল অর্জন ম্লান হয়ে গেছে। পাহাড়ে প্রতিনিয়ত হত্যা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা বাড়ছে। সেই সাথে বেড়েই চলেছে আধিপত্যের লড়াই।

(এএফিব/এইচআর/নভেম্বর ০২, ২০১৫)