নিউজ ডেস্ক : ‘সুখেরও লাগিয়া যে ঘর বাঁধিনু/অনলে পুড়িয়া গেল’—সুখের সংসার যেন অনলে পুড়ে না যায়। তাই সতর্ক থাকা উচিত সংসারে বসবাসকারী সব সদস্যদের। ‘সুখ’ নামের সুখ পাখিটা মরীচিকার মতো এই আসে এই যায়। স্থায়ীভাবে সুখ পাখিটাকে নিজের সংসারে ধরে রাখতে কী কী করা যায় তারই কিছু কৌশল জানাচ্ছেন— আরিফুন নেছা সুখী

পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে আদিম যুগে পরিবার ছিল না। পরিবারের সূত্রপাত হয় গ্রুপভিত্তিক পরিবার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এরপর গ্রুপভিত্তিক পরাির থেকে আসে যৌথ পরিবারের ধারণা। তারও অনেক পরে আসে বর্তমান একক পরিবার। পরিবার বলতে সহজ ভাষায় আমরা বুঝি মা-বাবা ভাই-বোন। কিন্তু মূলত পরিবার হলো ‘বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারীর যৌথভাবে বসবাস করার একটি সংগঠন। তারপর আসে তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি উত্তরাধিকারী।’ এরপর রক্তের সম্পর্ক। তবে অনেকেই মনে করেন, রক্তের সম্পর্কই পরিবারের মূল ভিত্তি।
কিন্তু পরিবারের মূল ভিত্তি স্থাপনকারী পুরুষ ও নারী কিন্তু একই রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। তাই ঐক্যসূত্রই পরিবারের মূল ভিত্তি।

সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখেই মানুষ পরিবার গঠনে আগ্রহী হয়। সবাই চায় সুখী গৃহকোণ। গৃহে ফিরে যদি সুখের চেয়ে কষ্টই বেশি পাওয়া যায়, তাহলে মানুষ গৃহী না হয়ে বৈরাগী জীবনযাপন করত।
গুণীজনে বলেন, ‘সুখ হলো আপেক্ষিক বিষয়, তা মানুষের মনের মধ্যেই থাকে। তাকে বাইরে থেকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অনুভব করতে হয়।’ তাই সুখের জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিতে হয় না। নিজের ভেতরে লালিত সুখকে নিজের জন্য তথা সবার জন্য সম্মুখে আনতে হয়।
সক্রেটিস বলেছেন, know thyself অর্থাৎ নিজেকে জান—মানে আমি কে, আমর কী আছে, আমি কোথায় আছি, আমি কী করছি এই ভাবনাটাই আমাকে সুখী বা অসুখী করে। অর্থাত্ আমি সুখ সম্পর্কে যা ভাবি সুখ মূলত তাই। আমরা যদি সুখের ওপর বিশ্বাস রাখি এবং মনে করি এটাই সুখ তবেই সুখ ধরা দেবে। নিজে সুখী হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত অন্যকে সুখী করা, ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে, করতে হবে ত্যাগ স্বীকার।

সুখী পরিবার গড়ে তুলতে পরিবারের ছোট থেকে বড় সবার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে কার কী ভূমিকা পালন করা উচিত, সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

কর্তা ও কর্ত্রীর ভূমিকা : স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানুষের জীবনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই সম্পর্ক সুস্থ ও সুন্দর না হলে জীবন সুখময় না হয়ে বিষময় হয়ে পড়ে। তাই সুখী সংসার গড়ার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই ভূমিকা অন্যতম। তাই ভালো বোঝাপড়া থাকতে হবে। ভুল বোঝাবুঝি যেন তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে দু’জনকেই সজাগ থাকতে হবে যেমন—
সন্দেহ করা। স্বামী স্ত্রী চাকরিজীবী এমন দম্পত্তি অহরহ। তাই দু’জনই বাইরে থাকেন, তাই ভুলেও সন্দেহকে আপন করে নেবেন না। সন্দেহ দেখা দিলে অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করে ফেলুন।
কোথাও কোন কিছু করলে বাসায় ফিরে দু’জন দু’জনকে বলুন। অন্য কারও কাছ থেকে শুনলে সম্পর্কে টান পড়তে পারে।
অন্যায় করলে স্বীকার করুন। অযথা তর্ক করবেন না, একজন বললে, আরেকজন শুনুন।
দু’জন দু’জনের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন।
একজন ভালো কাজ করলে তাকে বাহবা দিন, উৎসাহিত করুন।
বিশেষ বিশেষ দিনগুলো মনে করে একে অপরকে উপহার দিন।
নিজেদের জীবন নিজেদের মতো করে উপভোগ করুন। তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে এর মধ্যে প্রবেশ না করতে দেয়াই উচিত।
একে অপরের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। আপনি সম্মান দিলে দেখবেন আপনার দেখাদেখি অন্যজনও আপনার আত্মীয়কে সম্মান দেবে।
সময় সুযোগ বুঝে দু’জন বা পরিবারের সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে বের হন।
স্ত্রীরা স্বামীর কাছে নালিশ করতে পছন্দ করে, তাই তাদের একটু সামলে চলা উচিত, কথায় কথায় স্বামীর কানে সব কথা তুলবেন না, যদি খুব জরুরি কিছু মনে করেন তাহলে অন্তরঙ্গ কোনো মুহূর্তে আলাপচারিতার মতো করে বলুন। নালিশের সুরে নয়। বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সারাদিনে ঘটে যাওয়া ফিরিস্তি তার কানে না তোলাই ভালো। এ ব্যাপারটি পরিবারের সবাইকে ভেবে চলা উচিত। স্বামীকে পরিবারে অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিশতে দিন। নিজের সম্পত্তি মনে করে আগলে বসে থাকবেন না।
অন্যের স্বামী বা স্ত্রীর সমালোচনা নিজেদের মধ্যে না করাই ভালো।
যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একে অপরের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিন।
পরিবারটা যেহেতু নিজের তাই নিজের মতো করে দু’জন দু’জনকে বুঝুন।

মুরব্বীদের ভূমিকা : একটি পরিবারে মুরব্বী গুরুজন হলেন সেই পরিবারের বটবৃক্ষ। তাই সুখময় পরিবার গঠনে তাদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণই বলা যায়। যেমন—
নতুন বউকে নিজের মেয়ে বা নিজের পরিবারের একজন ভাবুন।
নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে তাকে সময় দিন। তাকে পরিবেশ বুঝতে সাহায্য করুন।
নতুন মানুষটি প্রশংসামূলক কাজ করলে তাকে বাহবা দিন। কটাক্ষ করবেন না। এতে সে ভুল ধারণা পাবে এবং সহজভাবে মিশতে পারবে না।
পুত্রবধূ চাকরিজীবী হলে তার কাজের সমালোচনা না করে কাজটির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
ছেলের কাছে বউয়ের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করবেন না। বরং তার প্রশংসা করুন এবং দু’জনকে একটু আলাদা সময় কাটানোর সুযোগ করে দিন।
সে কোনো ভুল করলে ভুলটা ধরিয়ে দিন এবং সংশোধনের সুযোগ দিন।

অন্যান্য জন : একটি পরিবারে মা-বাবা ছাড়াও থাকে ভাই-বোন, কারওবা দাদা-দাদি নানা-নানি, এমনকি অন্য আত্মীয়। তাই তাদেরও রয়েছে সুখময় পরিবার গঠনের কর্তব্য। তাদের যা করতে হবে তা হলো—
সবাই একসঙ্গে বাস করার মানসিকতা।
বড়দের সম্মান দেয়া, ছোটদের ভালোবাসা, বৃদ্ধদের অবহেলা না করা।
সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। কেউ কারও পেছনে না লাগা।
বিশেষ দিনে একে অপরকে উপহার দেয়া, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি মনে রাখা।
কেউ বিশ্বাস করে কোনো কথা বললে তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিন। কারও কথা কারও কাছে বলে ঝগড়া বাধাবেন না।
শেষ বেলায় বলতে হয়, সংসার নিজেদের, তাই এই সংসার সুখময় হবে না বিষময় হবে তা নিতান্তই নিজেদের ব্যাপার। তাই নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করুন। একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সবাই একটি পরিবারের। তাই পরিবারকে, পরিবারের মানুষগুলোকে আপন করে নিন। দেখবেন অধরা সুখ পাখি আপনার কাছে সুখ নিয়ে ধরা দেবে।