শরীয়তপুর প্রতিনিধি : অত:পর বাস্তবে রূপ নিচ্ছে দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলবাসীর দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পুরনের  কাজ। খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আর মাত্র ৩৬ মাসের মধ্যেই খুলে যাবে প্রায় ৫ কোটি মানুষের ভাগ্যের দুয়ার। বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে রচিত হবে এক নতুন ইতিহাসের।

জাজিরার পদ্মা পাড়ের মানুষ এখন আনন্দে আত্মহারা। চর জাগা মরা পদ্মার বাকে বাকে উপচে পরছে সম্পদ হারা মানুষের আনন্দের ঢেউ। স্বপ্ন বাস্তবায়নের শেষ ধাপে এসে বাবা-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি সব হারিয়েও খুশি পদ্মা পাড়ের শত শত মানুষ। তারা বরণ করতে প্রস্তুত প্রকান্ড এই সাফল্যের বর কণ্যাকে। প্রশাসনও সম্পন্ন করেছে তাদের সকল প্রস্তুতি।

দেশের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সেতুর মূল কাজের ৭ নং পিলালের পাইলিং স্থাপনের কাজ মাওয়ায় এবং নদী শাসনের কাজের উদ্বোধন করবেন জাজিরায়। এ জন্য মানুষের আনন্দের শেষ নেই। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা জোরদার এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য শুক্রবার শেষ বিকেল পর্যন্ত একের পর এক সভা করেছেন খোদ সেতু মন্ত্রী থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন, সেনা সদস্যসহ সকল আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। শনিবারে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহন করা করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

শনিবার সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হেলিকপ্টার অবতরণ করবে জাজিরার পদ্মা পাড়ে। এরপর ৯ টা ৫০ মিনিটে উদ্বোধন করবেন সেতুর দক্ষিন পাড়ের ১২ কিলোমিটার নদী শাসনের কাজ। সকাল ১০ টা থেকে ১১ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সেতুর জাজিরা পয়েন্টে বিভিন্ন স্তরের ১ হাজার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত সুধী সমাবেশে অংশ নিয়ে ভাষন দিবেন যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বেলা পৌনে ১২ টার মধ্যে তিনি পূনরায় আকাশ পথে রওনা দিবেন মাওয়ায় সেতুর মূল পিলারের উদ্বোধন শেষে জনসভায় অংশ গ্রহনের জন্য।


২০১৮ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন ও ট্রেন, এই মহা কর্মপরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে সবকিছু। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নেরর সুবিধার্থে মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মান, কনষ্ট্রাকশ ইয়ার্ড, পূনর্বাসন কেন্দ্র এবং একটি তদারকি পরামর্শক সংক্রান্ত মোট ৬টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাজিরা পাড়ের কনষ্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও পূনর্বাসন কেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে সংযোগ সড়ক নির্মানের কাজ। এছারাও মূল সেতু নির্মান কাজও দৃশ্যমান, শুরু হয়েছে নদী শাসনের কাজও। সমাপ্ত হয়েছে ২৭ শতাংশ অগ্রগতি। এ কাজে একসাথে হাত লাগিয়েছে চীন ও বাংলাদেশের শ্রমিক-কলা কুশলীরা। শুরুর দিকে কিছুটা হাতাশা থাকলেও বিশাল এই কর্মযজ্ঞ দেখে হতাশা কেটে গেছে স্থানীয়দের। ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের বাবা দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি হারিয়েও সব কিছু ভুলে গেছে সেতু নির্মানের কাজ শুরু হওয়াতে।

৬.১৫ কিলোমিটার দৈঘ্যের পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেতু প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চীনের চায়না ব্রীজ কোম্পানীকে। আর নদীর দুই পাড়ে চীনের সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮ হাজার ৭ শত ৮ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৪ কিমি এলাকা নিয়ে করা হচ্ছে নদী শাসন। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া পাড়ে ২ কিমি এবং শরীয়তপুর জাজিরা পাড়ে মূল সেতুর দুই পাশে ১২ কিমি পদ্মা নদী শাসন করা হচ্ছে।

নদী শাসনের কাজের ১৫ শতাংশ অগ্রগতিও হয়েছে ইতিমধ্যে। ৩ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজা নির্মান কাজ শুরু করেছে যৌথভাবে আব্দুল মোনেম নিমিটেড ও মালয়েশিয়ার এইচ.সি.এম নামের দুইটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সারে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক সহ প্রকল্পের সকল কাজ তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দক্ষিন কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেস ওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। সেতু নির্মানের সার্বিক কাজ তদারকির জন্য জাজিরার নাওডোবা এলাকায় নির্মান করা হয়েছে বিশাল সেনা ব্যারাক। ইতিমধ্যে মূল সেতুর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রীজ কোম্পানী ও সিনো হাইড্রো কর্পোরেশনের লোক জনেরাও থাকার জন্য দৃষ্টি নন্দন ব্যারাক নির্মান করেছে পদ্মা তীরে।

পদ্মা বহুমুখি সেতু নির্মাণের জন্য সরকার ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১টি ধাপে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে নাওডোবা ইউনিয়নের ১০০ নং এবং ১০১ নং মৌজার সরল খার কান্দি, মোহর আলী মাদবর কান্দি, হাজী হাছেন বয়াতীর কান্দি, সমর আলী মৃধা কান্দি, হাজী গফুর মোল্যার কান্দি, শহর আলী বেপারীর কান্দি, লতিফ ফকিরের কান্দি, সলিমুদ্দিন মাদবরের কান্দি, আহমেদ মাঝির কান্দি, হাজী জৈনদ্দিন মাদবরের কান্দি, কাদির মীনার কান্দি, জমির উদ্দিন হাওলাদারের কান্দি, আঃ মজিদ হাওলাদারের কান্দি, নঈমুদ্দিন খানের কান্দি সহ অন্তত ২৫টি গ্রামের ৪ হাজার ৮ শত ২৩ জন লোকের থেকে মূল সেতু, সংযোগ সড়ক, কনষ্ট্রাকশ ইয়ার্ড ও পূনর্বাসন কেন্দ্র নির্মানের জন্য ১ হাজার ১ শত একর ভূমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। আর । আর নদী শাসনের জন্য জাজিরা অংশে উল্লেখিত এলাকার বাসিন্দাদের থেকে নেয়া হয়েছে ১ শত ৫৫ একর জমি। সহস্র মানুষের কাছ থেকে অধিগ্রহনকৃত সেই ভূমির উপরই চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মহা কর্মজজ্ঞ।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব বৃহৎ এই প্রকল্পের বাস্তবতা আজ প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে বিশ্ব বাসী। দেশী- বিদেশী হাজারো ষড়যন্ত্রকে দুই পায়ে মাড়িয়ে নিজেদের অর্থে নির্মান হচ্ছে এই স্বপ্নের সেতু। জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনার ইস্পাত কঠিন মনোবল আর দৃঢ় সাহসিকতাই কেবল বিশ্ব ষড়যন্ত্রের মুখে চুন কালি মেখে দিয়ে এই অসম্ভব সত্যকে সম্ভব করার প্রত্যয়ে সফলতা পেতে শুরু করেছেন।

মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রমত্তা পদ্মার বুক চিড়ে আকাশের দিকে উকি দিতে থাকবে একের পর এক পিলার। আর প্রতিদিনই এই পথে যাতায়াতকারী দেশের লাখো মানুষ বিধাতার দরবারে হাত তুলে শুভকামনা করতে থাকবেন তাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে গৃহিত আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর তদারকি টিমের ডেপুটি চীফ কোর্ডিনেটর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা এখন জাতির স্বপ্ন পূরনের শেষ ধাপে অবতীর্ণ হয়েছি। শনিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

(কেএনআই/এএস/ডিসেম্বর ১১, ২০১৫)