বান্দরবান প্রতিনিধি : মৈত্রীময় স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় শান্তির বারতায় বয়ে আসুক নব বর্ষের শৈল্পিক শুভ্রতা। এই নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পাহাড়ের গায়ে লেগেছে মাহা সাংগ্রাই পোয়ে’র আনন্দের বন্যা। আজ মঙ্গলবার বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ৫দিন ব্যাপী মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব “সাংগ্রাই পোয়ে”। পাশাপাশি চাকমা, তংচংঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, খেয়াং, চাক এবং মুরং সম্প্রদায় বিজু, বৈসু ও চাংক্রান উৎসব পালন করছে।

আজ সকালে অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। এতে অন্যান্যের মধ্যে সেনা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান, জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, পৌর মেয়র মোঃ ইসলাম বেবী, জেলা পরিষদ সদস্য লক্ষ্মী পদ দাশসহ সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শত শত তরুন-তরুনীরা উপস্থিত ছিলেন। শোভাযাত্রা শেষে স্থানীয় রাজার মাঠে বয়স্ক পুজা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

“সাংগ্রাই-মা ঞি-ঞি ঞা-ঞা রি ক্যাজাই কা-পা-মে” মারমা গানের মন-মাতানো সুরে পাহাড়ের প্রতিটি পল্লীতে চলছে নানা বয়সী নারী-পুরুষের আনন্দ ও উচ্ছাস। পাহাড়ে বসবাসরত ১১টি নৃ গোষ্ঠির মধ্যে মারমা, মুরং, চাকমা, ত্রিপুরা, তংচংঙ্গ্যা পৃথক ভাবে নিজ সম্প্রদায়ের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে বর্ষবরণ উৎসবটি উদযাপন করে আসছে আদিকাল থেকে। চাকমা, তংচংঙ্গ্যা, ত্রিপুরা এবং মুরং সম্প্রদায় বাংলা বর্ষবরনের আগে বিজু, বৈসু-বৈসুক এবং চাংক্রান হিসেবে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহা আনন্দে উদযাপন করে থাকেন। এতে ব্যাতিক্রমী হিসেবে তংচংঙ্গ্যাদের ঘিলা খেলা পুরানো ঐতিহ্য বহন করে। প্রতিবছর ২দিন ব্যাপী ঘিলা খেলার আয়োজন করে থাকে তংচংঙ্গ্যা সম্প্রদায়। এই খেলায় তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তরুণ তরুনীরা দল বেঁধে অংশ নেয়।

তবে পাহাড়ে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধরে রেখে মারমা সম্প্রদায় বর্ণাঢ্য নানা চোখ ধাঁধানো আয়োজনে বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানটি মহাসমারোহে পালন করে থাকেন। মারমা সম্প্রদায়ের বর্ষ পঞ্জী হিসেবে ১৩৭৭ কে বিদায় জানিয়ে ১৩৭৮ কে বরণ করে নিচ্ছেন। মৈত্রীময় পানি বর্ষনের মাধ্যমে অতীতের সকল দুঃখ, জরা, গ্লানী, পাপ-পংখীলতা ধুয়ে মুছে সুখ সমৃদ্ধির প্রত্যাশা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সম্প্রীতির আগমনী বার্তা নিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছেন মারমা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ। ৫দিনের মহা আয়োজনে রয়েছে শোভাযাত্রা, ম্যারাথন, শিশুদের চিত্রঙ্কন প্রতিযোগিতা, বয়স্ক পুজা, বৃদ্ধ মূর্তি স্নান, হাজার বাতি প্রজ্জ্বলন, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহন, রাতব্যাপী পিঠা তৈরীর উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফানুস উড়ানো এবং সর্ব শেষ মৈত্রীময় পানি বর্ষন অনুষ্ঠান। তবে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বৌদ্ধ বিহার গুলোতে ভিড় লেগে থাকে। নিজেকে পবিত্র করে রাখার জন্য শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সের নারী-পুরুষ ধর্ম দেশনা শুনতে ভীড় জমান বৌদ্ধ বিহার গুলোতে। এ সময় পিন্ড দান, বুদ্ধ পুজা, প্রদীপ পুজাসহ ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান পালন করেন বৌদ্ধরা।

মারমা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য হচ্ছে মৈত্রী পানি বর্ষন অনুষ্ঠান। একে অপরকে পানি ছিটিয়ে নতুন বছরকে সানন্দে বরণ করে নেন। মারমাদের এই ঐতিহ্য ছাড়াও বান্দরবানে বেশ কয়েকটি ব্যাতিক্রমী অনুষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে বুদ্ধ মূর্তি স্নান ও হাজার বাতি প্রজ্জলন অনুষ্টানটি একমাত্র বান্দরবানেই হয়ে আসছে আদিকাল থেকে। বুদ্ধ মূর্তি স্নানের তাৎপর্য হচ্ছে বুদ্ধের মূর্তিকে ধুয়ে পরিস্কার করা আর মূর্তি ধোঁয়া পানি পান করার মাধ্যমে রোগ মূর্তি কামনা করা। বুদ্ধ মূর্তি সব সময়ের জন্য পবিত্র থাকেন তাই পবিত্র মূর্তির পানি পান করে মানুষের দীর্ঘদিনের পাপ মুছন করেন এবং কারো জটিল রোগ থাকলে তা ভাল হয়ে উঠে বলে তাদের বিশ্বাস। এ ছাড়াও মানুষের কর্মব্যস্ত জীবনে হাজার বার্তি জ্বালানোর মতো মহা পুণ্যের কাজ সম্পাদন করতে পারেন না। তাই রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারের সামনে সাংগ্রাই এবং ওয়াগ্যই উৎসবে হাজার বাতি প্রজ্জলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যারা এই হাজার বাতি প্রজ্জলন অনুষ্টানে অংশ নেয় তারা পুণ্যবতী। এখানে ১টি বাতি জ্বালালেও হাজার বাতি জ্বালানোর পুণ্য এক সাথে পেয়ে থাকেন।

বাংলা নববর্ষের নব দিগন্তে অহিংসার বাণী আর পাহাড়ীদের বর্ষ বরণ হোক শান্তির সুপ্রভাতে।

(এএফবি/এএস/এপ্রিল ১২, ২০১৬)