বান্দরবান প্রতিনিধি :বান্দরবানের দুর্গম থানছি উপজেলায় আবারো খাদ্য সংকটের কবলে পড়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গতবছর জুমের ধান ঘরে তুলতে না পারায় চলতি বছরের মার্চ থেকে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। খাদ্য সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরকারের উচ্চ মহলে বিষয়টি অবহিত করে যাচ্ছেন। এতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরীভাবে দুর্গত এলাকায় ৮শত পরিবারের বিপরীতে ১৬ মেঃটন চাল বরাদ্দ দিয়েছে । যা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অনেক কম।



থানছি উপজেলার দুর্গম জনবিচ্ছিন্ন পাড়া গুলোতে বসবাসরত পাহাড়ীদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম জুম চাষ। জুম চাষের মাধ্যমে তারা সারা বছরের ধান সংগ্রহ করে রাখেন। আদিকাল থেকে পাহাড়ীরা জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাহাড়ীদের প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের চোখে মুখে ক্ষুধার জ্বালা। অনেক পরিবার আছে যারা দু’বেলাই ভাতের দেখা পান না। অনেকে আবার একবেলা ভাত অন্য বেলা আলু বা মিষ্টি কুমড়া খেয়ে জীবন প্রদীপ বাঁচিয়ে রাখছেন।

রেমাক্রী ইউনিয়নের যোগী চন্দ্র পাড়ার হাতিরাম ত্রিপুরা জানান, তার পরিবারের ৬ জন সদস্য ৩দিন না খেয়ে থাকার পর বিজিবি’র একটি নতুন নির্মানাধীন বিওপিতে কাজ করে ১০ কেজি চাল পেয়েছেন। সেই চাল দিয়ে ৩/৪দিন পার করতে পারবেন।

বড়মদক ভীতর পাড়ার বাসিন্দা ক্য মং উ মারমা (৭৫) জানান, ২ নাতি নিয়ে তাদের ৪ জনের সংসার। কোথাও কাজ নেই। কাজ থাকলেও বয়সের কারনে কেউ কাজ দেয় না। চিকিৎসার অভাবে একটি চোখ হারাতে বসেছেন। তার উপরে খাবারের অভাব। ঘরে অনেকদিন ধরে চাল নেই তাই তার স্ত্রী মাম্যাচিং (৬০) জঙ্গল থেকে আলু সংগ্রহ করে সিদ্ধ করে খাওয়াচ্ছেন। মৃত্যুর আগে ভাতের স্বাদ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে মরতে চান মদক ভীতর পাড়ার এই অসহায় বৃদ্ধ।

হৈয়োক খুমী পাড়ার কারকারী হৈয়ুক খুমি জানান, তার পাড়ায় ২৭টি পরিবার আছে। কোন পরিবারে এক মুটো খাবারের চাল নেই। চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে প্রতিটি পরিবার। তিনি সরকারের কাছে দ্রুত খাদ্য সরবরাহ করার দাবি জানান।

রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬ নং ওর্য়াড মেম্বার মাংচং ম্রো জানান, সাঙ্গু রির্জাভ এলাকায় বেশ কয়েকটি পাড়া রয়েছে। এসব পাড়ার কারো কাছে খাবারের চাল নেই। গত ২ মাস আগে থেকে জুম ধান শেষ হয়ে গেছে পাড়া গুলোতে। তাই ঐ এলাকার মানুষ ভাত খেতে না পেয়ে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে বলে আশংকা তার। তিনি জরুরী ভিত্তিত্বে সরকারি বা বেসরকারি খাদ্য শষ্য বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানান।

সরেজমিনে এসব এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ পরিবার জঙ্গলী আলু, মিষ্টি কুমড়া আর কলা গাছ খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বান্দরবানের থানছি উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অতি দুর্গম রেমাক্রী ও তিন্দু ইউনিয়নের প্রতিটি ঘরের চিত্র এখন ছবির মতোই। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত বছর পাহাড়ে জুম চাষ করে ধান পায়নি জুমিয়া পরিবার গুলো। যেটুকু ধান পেয়েছেন তা ২/৩ মাসেই শেষ হয়ে গেছে। ফলে এক বেলা আধা বেলা খেয়ে বা সারাদিন আলু আর কলা গাছ খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে উপজেলার প্রায় আড়াই হাজার পরিবারকে।

এ বিষয়ে ১নং রেমাক্রী ইউনিয়নের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান মুই শৈ থুই মারমা রনি জানান, তার ইউনিয়নে ৯৫ শতাংশ মানুষ জুমনির্ভর। গত বছর জুমধান ভাল না হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবার। তিনি আরো জানান, তার ইউনিয়নে বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়নি। প্রতিটি পরিবারে নানা জাতের ফলজ বাগান রয়েছে কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে বাজার জাতের সুযোগ না থাকায় গাছেই ফল পচে যায়। ফলে জুমের ফলনের উপর নির্ভর করতে হয় সকলকে। জুমের ধান হলে মুখে হাসি থাকে আর ধান না হলে দুর্বিক্ষের ছাপ লেগে থাকে সকলের চোখে মুখে। তিনি জানান বর্ষার কারনে সামনের তিন মাস সারাদেশের সাথে দুর্গম অর্ধশতাধিক গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন এই সংকট আরো প্রকট হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে অনেক গুলো পরিবার সংকটাপন্ন । তাই তিনি সরকারী-বেসরকারী ভাবে জরুরী ভিত্তিত্বে খাদ্য শষ্য বরাদ্ধ চান।

এদিকে ২নং তিন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মং প্রু অং মারমা জানান, তার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি এলাকা অতিদুর্গম এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ঐ এলাকায় প্রায় ৬/৭শত পরিবার এখন খাদ্য সংকটে ভুগছে। জরুরী ভাবে খাদ্য না পেলে খাদ্যের অভাবে মানুষ মারাও যেতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেছে।

এবিষয়ে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানান, দুর্গত এলাকার জন্য ১৬ মেঃটন খাদ্যশষ্য বরাদ্দ করা হয়েছে প্রতি পরিবারকে ২০ কেজি করে। জরুরীভাবে ৮শত পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় খাদ্য পৌছাতে একটু সমস্যা হচ্ছে তবে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদীর পানি স্বাভাবিক হয়েছে তাই দুর্গত এলাকায় জরুরী ভাবে খাদ্য পৌছে দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এই সংকট মোকাবেলা করার জন্য সরকারী ভাবে পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য শষ্য আছে। যেহেতু এই খাদ্য সংকট অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে তাই বিষয়টি সরকারের জানানো হয়েছে। যাতে ভিজিএফ’র মাধ্যমে ব্যবস্থা করা যায়।



(এএফবি/এস/মে২৩,২০১৬)