প্রান্ত সাহা : বিশ্বকাপের গত হওয়া উনিশটি আসরের পরিসংখ্যান বলে প্রতি তিনটা বিশ্বকাপের একটি জিতেছে স্বাগতিকরা। ইতিহাস অবশ্য আরও একটা অপূর্ণতা বয়ে চলেছে, এ যাবৎ বিশ্বকাপ জেতা দেশগুলোর মধ্যে কেবল ব্রাজিলই ঘরের মাঠে শিরোপা জিততে পারেনি!

পরিসংখ্যান আর ইতিহাস যাই বলুক, পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সামনে শিরোপার যেমন কোনো বিকল্প নেই, তেমনি গ্রুপিং আর ফিক্সচারের সরলতম হিসেবে ১৩ জুলাইয়ের সাজানো মঞ্চে পৌঁছানোর পথটা মোটেও সহজ হচ্ছে না। ইতিহাসের দায় মেটাতেই হোক আর গ্রুপ-ফিক্সচারের কঠিন বাস্তবতা মোকাবেলাই হোক, লুই ফিলিপ স্কোলারিকে তাঁর সেরা একাদশটাই বেছে নিতে হবে। কেমন হতে পারে সেটা? কারা থাকবেন সেলেসাওদের স্বপ্নপূরণের মূল ছকে? চলুন একটু দেখে নেয়া যাক।

জুলিও সিজার

গোলরক্ষক
গেলো এক বছরে স্কোলারির গোলপোস্টে বেশীরভাগ সময় জুলিও সিজারকেই দেখা গেছে। ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার সিজারকে হয়তো তরুণ বয়সের চটপটে রূপে পাওয়াটা কঠিন হবে কিন্তু ইন্টার মিলানের ফর্ম আর গত বছরের কনফেডারেশন্স কাপের পারফরম্যান্স বলে ৩৪ বছরের হাতদুটো এখনও আস্থা হারায় নি। কনফেডারেশন্স কাপের সেমিফাইনালে উরুগুয়ের একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেয়ার মতো সিজারের দুর্দান্ত কিছু সেভ খুঁজে পেতে খুব বেশী দূর যেতে হবে না, সাম্প্রতিক ম্যাচগুলো দেখলেই চলবে।

ডেভিড লুইজ, থিয়াগো সিলভা
রক্ষণভাগ
সেলেসাওদের সবচেয়ে ভরসার জায়গাটায় ডান পাশে প্রথম পছন্দ নিশ্চিতভাবেই দানি আলভেজ। ক্ষিপ্র গতিতে বল কাটিয়ে নেয়ায় দারুণ পারদর্শী। বার্সা ডিফেন্ডারের বাঁধা টপকানোটা যে কোনো নামি ফরোয়ার্ডের জন্যই কঠিন হবে। আর হ্যা, ক্লাব ক্যারিয়ারে ৩৮টি এবং জাতীয় দলের হয়ে ৭টি গোলের মালিক আলভেজ প্রতিপক্ষ ডি-বক্সের বাইরে থেকে লম্বা শটে জাল খুঁজে নিলে অবাক হবেন না যেন! এই দু’দিন আগেও তো বিশ্বকাপের ওয়ার্ম আপ ম্যাচে পানামার জালে বল ঢুকিয়েছেন! জরুরী প্রয়োজনে আলভেজের বিকল্প হতে পারেন ইতালিয়ান ক্লাব রোমার রাইট ব্যাক মাইকন সিসেনাদো।

সেন্টার ব্যাকে গেল দশকের ব্রাজিলিয়ান জুরি জুয়ান-লুসিওর নিখুঁত প্রতিস্থাপন বলা যায় থিয়াগো সিলভা আর ডেভিড লুইসকে। অ্যাটাকিং লুইস-ডিফেন্সিভ সিলভা, ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট পিএসজির দুই সতীর্থ সেলেসাও ডিফেন্সকে আক্ষরিক অর্থেই অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন। বাতাসে বল ভাসিয়ে লক্ষ্য ভেদ করতে ভালোবাসেন দু’জনেই, ব্রাজিল সাইডের কর্নার কিকগুলোতেও তাই সিলভা-লুইস ঘুরেফিরে আসবেন। সিলভার যে সামান্য চোটের কথা শোনা যাচ্ছে সেটা গুরুতর কিছু হলে লুইসের সঙ্গী হবেন বায়ার্ন ব্যাক দান্তে।

বাঁ পাশের ডিফেন্সে মারসেলো কিংবা ম্যাক্সওয়েল যে কাউকেই দেখা যেতে পারে। তবে ক্লাব আর ন্যাশনাল টীম পারফরম্যান্সে রিয়াল মাদ্রিদ লেফট ব্যাক মারসেলোকেই এগিয়ে রাখতে হবে। অসাধারণ ড্রিব্লিং কৌশলে বল পায়ে উপরে উঠে সুযোগ তৈরির চেষ্টাটা ২৬ বছরের মারসেলোয় আলাদা করেই চোখে পড়ে। কিন্তু লেফট ব্যাকের পাশাপাশি লেফট উইংয়েও স্বচ্ছন্দ ম্যাক্সওয়েল প্রতি ম্যাচেই নব্বই মিনিট রিজার্ভ বেঞ্চে কাটাবেন এমনটা ভাবার বোধহয় কোন কারণ নেই।

অস্কার
মধ্যমাঠ
স্কোলারির ছকে সবচেয়ে বেশী রদবদলটা সম্ভবত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডেই দেখা যাবে। বছরখানেক আগেও এই পজিশনের নিয়মিত জুটি ছিলেন পলিনহো আর গুস্তাভো। কিন্তু ইঞ্জুরির কারণে টটেনহ্যামে প্রথম মৌসুমটা বেশীরভাগ সময় টাচলাইনে কাটাতে হয়েছে পলিনহোকে, বিশ্বকাপেও একটা লম্বা সময় তাঁকে তাই করতে হতে পারে। তবে গুস্তাভো যথারীতি রক্ষণভাগের পাহারায় নেতৃত্ব দেবেন। তারকায় ঠাসা বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে উলফসবার্গে যোগ দিয়ে উল্ভসদের সবচেয়ে ধারাবাহিক প্লেয়ার বনে গেছেন। বল পায়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিয়ে গতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পেরেছেন। গুস্তাভোর সঙ্গী হিসেবে প্রথম একাদশে দেখা যেতে পারে খুনে গতির র‌্যা মিরেসকে। বলের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণটা আরেকটু বাড়লে রক্ষণ-আক্রমণে দারুণ একটা যোগসূত্রই পাবে ব্রাজিল। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নিয়মিত ম্যাচ শুরু করা ফার্নান্দিনহোও এই পজিশনের চমৎকার বিকল্প।

অ্যাটাকিং মিডফিল্ডের মধ্যমণি হিসেবে চোখ বন্ধ করেই একজনের নাম বলে দেয়া যায়, অস্কার। চেলসির হয়ে সাম্প্রতিক ম্যাচগুলোতে অধিকাংশ সময় বদলি হয়েই নেমেছেন। কিন্তু স্কোলারির একাদশে অস্কারের উল্কাগতি, শকুনে দৃষ্টি আর ধারাবাহিকতা সেরা মূল্যায়নটাই পাবে সন্দেহ নেই। প্রয়োজনে অস্কারের জায়গা নেবেন তাঁরই ক্লাবসতীর্থ উইঙ্গার উইলিয়ান।

নেইমার ও ফ্রেড
আক্রমণভাগ
ফ্রেডের ইঞ্জুরিতে সেলেসাওদের সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে শুন্যতাটা খোলা চোখেই দেখা গেছে। ব্রাজিলিয়ানদের আশায় ছাই ঢেলে ডিয়েগো কস্তা স্পেনের প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নিলে সংকটটা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল। যাই হোক, ফ্রেড ফিরেছেন। সার্বিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের সর্বশেষ গা গরম ম্যাচে গোলও পেয়েছেন। ৯ নম্বর জার্সিতে ফ্রেডের পুরনো রূপ সত্যি সত্যিই ফিরে আসলে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের শঙ্কাটা যে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে তা বুঝতে বোদ্ধা হওয়া লাগে না।

বাঁ উইং থেকে আক্রমণ গড়ে দেয়ার মিশনে নেতৃত্ব দেবেন সেনসেশনাল নেইমার। সেলেসাওদের জুনিয়র ‘পেলে’র বল পায়ে কারিশমা বর্ণনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না! প্রত্যাশাটা চাপ হয়ে না দাঁড়ালে ‘ব্রাজিল ডার্লিং’ গোল করবেন, করাবেন। তাঁর বিপরীতে ডান উইং দখলে রাখবেন জেনিত উইঙ্গার হাল্ক। লক্ষ্যভেদী শট আর গতি কুশলী হাল্কের জায়গাটা প্রথম একাদশে নিয়মিতই রাখবে। তবে গত গ্রীষ্মের মতো আকস্মিক ছন্দ হারালে হাল্কের ব্যাক আপ হবেন শাখতার ডোনেস্কের তরুণ বার্নার্ড।

(এটিআর/জুন ০৮,২০১৪)