রূপক মুখার্জি : বাংলা বর্ষবরণের বড় অনুসঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা পাওয়ায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন ভুবন প্রিয় হলো। এই স্বীকৃতি বাঙ্গালী জাতি সত্তাকে আরো মহীয়ান করলো। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে সগর্বে স্থান করে নিলো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই স্বীকৃতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অশুভ’র বিরুদ্ধে শুভরও বিজয়। বাঙ্গালী সাংস্কৃতির সুর বাজুক বিশ্বময়।

খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ উৎসবের সূচনা করেন। সব মানুষের প্রাণের উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ । মৌলবাদী চক্রের আগ্রাসী ষড়যন্ত্রের কারণে কোন কালেই নববর্ষ উৎসব পালন করা সুখকর ছিল না । পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এ উৎসব আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেও বাঙ্গালী সে প্রতিবন্ধকতা মানে নাই। ষাটের দশকে বাঙ্গালী ছায়ানটের ডাকে প্রাণের আহ্বানে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবে মিলিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও একাধিক বার বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্বৈরাচারী শাসনামলেও বর্ষবরণ উৎসব পালনে হুমকি ধামকি ছিল ।

বর্ষ বরণ উৎসবে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রথম সূচনা হয়েছিল যশোর শহরে। স্বৈরাচারী শাসনামলে চারুপিঠের শিল্পী মাহবুব জামাল এর একান্ত উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার গোড়াপত্তন হয়। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক কর্মচারীরা বর্ণিল শোভাযাত্রা করে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন, তা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রার চেতনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সড়ক ছাড়িয়ে বিশ্বের মহাসড়কে বিস্তৃত হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বরাতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া সেই অসাধারণ ঘটনারই এক বৈশ্বিক স্বীকৃতি। বাংলা ও বাঙ্গালীর এ এক অনন্য অর্জন।

মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বীকৃতিটি একটু ভিন্ন রকম । বিশ্বের যে সব সাংস্কৃতিক চর্চা, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার–অনুষ্ঠান সমগ্র মানব জাতির জন্য কল্যানকর বিবেচিত হয়, সেগুলোকে ইউনেস্কো ‘বিশ্ব সভ্যতার স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে। বাঙ্গালীর বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানের মঙ্গল শোভাযাত্রা এই অনন্য সম্মান অর্জন করায় বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির মানবিক সৌন্দর্য ও শক্তি সম্পর্কে বিশ্ব আরো বেশি করে জ্ঞাত হতে পারবে।

ইউনেস্কো যথার্থই বলেছে যে, “অশুভ কে দূর করা, সত্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক-‘ মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙ্গালীর ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরণের বৈশিষ্ট এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।” প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লাখো মানুষ প্রাণের উৎসব উদযাপন করতে আসেন। সারা দেশও হয়ে ওঠে যেন এই শোভাযাত্রার সঙ্গী । নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার এই বিশ্বজয় আমাদেরকে আরো সাহসী করবে। এর মাধ্যমে বাঙ্গালী সংস্কৃতির উদার, মানবিক ও প্রকৃতিমুখী বার্তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হবে।

মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বীকৃতি উদযাপনের সময় আমাদের একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যান্য স্মারককেও যথাযথ ভাবে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার অঙ্গীকার। দানবীয় শক্তি বিনাশে ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালীর প্রাণের স্ফুরণ।
(আরএম/এএস/ডিসেম্বর ০৩, ২০১৬)