এম এ গনি


১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের চারদিন পর ২১ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু কবে, কখন এসব কিছুই জানানো হয় না।

২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর মধ্য রাত থেকে পরের বছরের ৮ জানুয়ারি। নয় মাসের বন্দী জীবন শেষে বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। সেদিনই তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বিশেষ ফ্লাইট ৬৩৫-এ লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ কর্মকর্তারা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। সেইদিন লন্ডনের হোটেল ক্যারিজ এ জনাকীর্ন সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমার ও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ৭ জানুয়ারি আমি আমার এক বন্ধু এয়ার কমোডর বোস যিনি লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত ছিল, তার মাধ্যমে জানতে পারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আগামীকাল ৮ জানুয়ারি লন্ডন আসবেন পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে। খুব সকালে লন্ডন এ পৌঁছবেন এবং জানতে পারি হোটেল ক্লারিজ এ উঠবেন।

আমি ভোর ৬ টায় হোটেল ক্লারিজে এর লবিতে পৌঁছায়। বঙ্গবন্ধু হোটেল লবিতে পৌঁছলে পায়ে ধরে সালাম করি এবং তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে তোরা কেমন আছিস? আসলে বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক অনেক আগে থেকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারণার জন্য শেরেবাংলা এক ফজলুল হক, শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর সাথে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম আসলে আমার সাথে সর্বপ্রথম পরিচয় ঘটে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নির্দেশ পালনে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। ১৯৬৩ সালে সেই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সর্ব প্রথম কমিটির সভাপতি মরহুম জানে আলম দোভাষ- সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হয়ে ছিলাম বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া কমিটিতে এর চেয়ে প্রাপ্তি কি আছে আমার জীবনে। ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে মুসলিম লীগ এর শক্তিশালী প্রাথীকে হারিয়ে দিয়ে অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়েছিলাম । এর প্রেক্ষিতে আমি চট্টগ্রাম মিউনিসিপালটি এর কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছি । ১৯৬৫ সালে নিখিল পাকিস্তান যুব আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিত্ব করার গৌরব অর্জন করেছিলাম। খুব অল্প বয়সে চট্টগ্রামের সেই সময়ের ১০০ বছরের পুরাতন চট্টগ্রাম কো -অপারেটিভ ব্যাংক এর পরিচালক হয়েছিলাম । ১৯৬৭ সালে তত্কালীন স্বৈরশাসক আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলাম এবং পুলিশের হাতে বেধড়ক লাঠিপেঠার পর গ্রেফতার হয়েছিলাম ।

সেই সময় পুলিশের লাঠিপেটা থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার সাজেদা চৌধুরী না বাঁচালে হয়তো আজ এই পর্যন্ত আসতে পারতাম না। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক সফরের কারণে লন্ডন আসলে, সফরসঙ্গী হিসাবে আমাদের আজকের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রয়াত ওয়াজেদ মিয়া সাথে ছিলেন। সেই সময় বঙ্গবন্ধু আমাদের মরহুম আবদুল জলিল ( আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ (বর্তমান বিএনপি নেতা) সহ আলাপের সময় আব্দুল জলিলকে একপর্যায়ে বাংলাদেশে সাথে করে চলে যেতে বলে। বংলাদেশে হুলিয়া থাকার কারণে দেশে না গিয়ে ইংল্যন্ডে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে কাজ করার জন্য নির্দেশ পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন বার্মিংহাম ছিলাম , এখানে প্রথম স্বাধীনতার পক্ষে একটি একশন কমিটি করা হয় যার নাম" একশন কমিটি ফর বাংলাদেশ" যার সভাপতি ছিলাম আমি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় সাবেক রাষ্ট্রদূত মোজাম্মেল হোসেন টমি হক। পরবর্তীতে লন্ডনে কেন্দ্রীয স্টিয়ারিং কমিটি করা হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে, এর মাধ্যমে আমরা নয় মাসব্যাপী ম্যানচেস্টার, বার্মিংহামসহ বিভিন্ন শহরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলি। বার্মিংহাম থেকে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের #একশ্যান কমিটি# এর সাধারণ সম্পাদক হয়ে কাজ করার কারণে পাকিস্তানীরা আপনার গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই কথা তত্কালীন বার্মিং হ্যাম, ম্যানসেস্টার শহরের সব বাঙালিরা জানেন- আমার সেই সময়ের দেশের বাইরে পাকিস্থান এর বিরুদ্ধে লড়াই এর ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার আগে লন্ডন গেলে আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর একই বিমানে দেশে যাওয়ার কথা থাকলেও আপনার কাছে বঙ্গবন্ধুর কিছু অর্পিত দায়িত্বের কারণে যেতে পারিনি । পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে গেলে আমাকে যে সংবর্ধনা দিয়েছিল, সেই সংবর্ধনায় তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন ।

১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি সেই সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন নতুন রাষ্ট্রের জনক, যা এখনো আমার মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধু বলেন, The ultimate achievement of the struggle is the creation of the independent, sovereign republic which my people have declared me President while I was a prisoner in a condemned cell awaiting the execution of a sentence of hanging. I would like to thank all those freedom-loving states who have supported our national liberation struggle, in particular India, the Soviet Union, Poland, other Eastern European countries, the United Kingdom, France- and also those freedom-loving people around the world who supported our cause, including the people of the United States of America.

৯ জানুয়ারি হিথরো থেকে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে ঢাকার পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডনে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের সময় তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ঢাকার পথে ১০ জানুয়ারি তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে (ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট) যাত্রা বিরতি করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্য ও শীর্ষ কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের জাতির পিতাকে ঐতিহাসিক অভ্যর্থনা জানান। একুশ গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়, ওড়ানো হয় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পতাকা। বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত।

বঙ্গবন্ধুকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্তব্য করেন, The emergence of independent Bangladesh is itself a unique event in the annals of democratic movements in world history.You have truly been acclaimed the Father of the new nation , Bangladesh . বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ, সরকার, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই দিন নতুন দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছান বঙ্গবন্ধু।
কারাগারে থেকেও যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সেই প্রাণপ্রিয় নেতাকে মুক্ত স্বদেশে স্বাগত জানায় লাখো উদ্বেলিত জনতা। রয়াল এয়ার ফোর্সের বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দরে থামার পর সেটাকে ঘিরে লাখে লাখে মানুষ, যা দেখবার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ধরে বিমানের জানালা দিয়ে তাঁর প্রাণপ্রিয় ‘সোনার বাংলা’ দেখেন। এরপর মোটর শোভাযাত্রায় রমনা রেসকোর্সে পৌঁছান।

ইন্দিরা গান্ধী বিলক্ষণ অনুধাবন করেছিলেন যে, পাকিস্তান কেবল পরাজিতই নয় দেশটির ৯৩,০০০ সৈন্যও বাংলাদেশ-ভারতের কাছে বন্দী, কাজেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই পাকিস্তানের। ১৬ ডিসেম্বর লোকসভায় পাকিস্তানী আত্মসমর্পণের সুখবরটি জানাতে গিয়ে ভারত নেত্রী আশা প্রকাশ করেন এই বলে, We hope and trust that the Father of this new nation, Sheikh Mujibur Rahman, will take his rightful place among his own people and lead Bangladesh to peace, progress and prosperity.

রমনা রেসকোর্সে ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দান ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালী, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন।’

যতটুকু সান্নিধ্য বঙ্গবন্ধুর পেয়েছি তাতেই আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ঋণে আজীবন আবদ্ধ ছিলাম, আজও আছি। সেই ঋণের কিছু হলে শোধ করার জন্য জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নেতৃত্বে আমৃত্যু আজ করে যাবো। একসময় অনেক বলেছে সেইদিনের সেই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার বিষয়টা আমার বানানো গল্প। আওয়ামী লীগ এর আর্কাইভ থেকে এই ছবি সেই প্রতিহিংসা পরায়ণ মানুষের মুখে লজ্জার কালিমা মেখে দিয়েছে। আওয়ামী লীগকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে বর্তমান সময়ে বাংলা ও বাঙালির চিন্তা ও কল্যাণের অধীশ্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করে যাবো আমৃত্য এই হোক আমার জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের অঙ্গীকার। জয়বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : সাধারণ সম্পদক, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ।