প্রবীর বিকাশ সরকার


[ভূমিকা : কুমিল্লার গৌরবোজ্জ্বল একটি প্রতিষ্ঠান মহেশাঙ্গন। আমার শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম লগ্নে গভীর গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে। এই স্থানটি নিয়ে আমার ভাবনার শেষ নেই। এত শান্তিপূর্ণ, স্বপ্নীল এবং রোমান্টিক জায়গা বাংলাদেশে আর আছে বলে আমার জানা নেই। কত আড্ডা যে এখানে কলেজজীবনে দিয়েছি তার হিসেব নেই। প্রায় মহেশাঙ্গন আমার স্বপ্নে দেখা দেয়। ১৯৮৪ সালের পর যতবার কুমিল্লা গিয়েছি এখানে সকালে বা সন্ধেবেলা না গিয়ে থাকতে পারিনি। ২০০৩ সালে আমি একটি উপন্যাস লিখি ‘তালা’ নামে এই মহেশাঙ্গনকে কেন্দ্র করেই। ২০১৫ সালে প্রকাশিত আমার আরেকটি উপন্যাস ‘রাহুল’-এও মহেশাঙ্গনের চিত্র আছে। এই লেখাটি লিখেছিলাম ঢাকার একটি ম্যাগাজিনে নামটি ভুলে গেছি। বেশ কয়েকদিন ধরে একাধিক বন্ধু জানতে চেয়েছেন দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য এবং রামমালা গ্রন্থাগার নিয়ে আমার কোনো লেখা আছে কিনা। তাদেরসহ অন্যান্য বন্ধুদেরও জানার জন্য লেখাটি তুলে দিলাম। আজকে চতুর্থ পর্ব]

তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বর পাঠশালা ভারতভাগের পূর্বে দীর্ঘ সোনালি যুগের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল প্রথম প্রধান শিক্ষক পণ্ডিত জানকীনাথ সরকারের কল্যাণে। পাকিস্তান আমলেও এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছিল সর্বত্র। স্বাধীনতার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে দ্রুত এর ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে থাকে। এই বিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। যেমন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড.অম্লান দত্ত, কবি অমিয় চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী অজিত চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী বিমল কর, ব্যাকরণবিদ অধ্যাপক ড.হরলাল রায়, শিক্ষাবিদ অজিতকুমার গুহ, ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার, নজরুলসঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক সুধীন দাশ প্রমুখ।

কর্মযোগী মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহেশাঙ্গনের ইতিহাস দু’চার কথায় লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। কুমিল্লা মহেশাঙ্গনের ইতিহাস সমগ্র বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ১৯০৬ সাল থেকে বর্তমান কাল এই শতবর্ষ ধরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে প্রচণ্ড তরঙ্গাভিঘাত প্রবাহিত হয়েছে বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের সেইসব পরিবর্তনের ইতিহাস মহেশ প্রাঙ্গণের সঙ্গে জড়িত। স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গেও মহেশাঙ্গন জড়িত ছিল গভীরভাবে। রামমালা ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ রাসমোহন চক্রবর্তী মনেপ্রাণে স্বদেশী ছিলেন ফলে আন্দোলনে জড়িত এমন সন্দেহে ৬ মাস রাজবন্দি হিসেবে ঢাকা ও কুমিল্লায় জেল খেটেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা আলোড়ন তুলেছেন এবং পরিবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাঁদের অধিকাংশই মহেশাঙ্গনে পদার্পণ করেছেন, সভা করেছেন তাঁরা হলেন, এ. রসুল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন বসু, বিপিন পাল, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিসি রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, কস্তুরীবাই গান্ধী, মৌলভী লিয়াকত হোসেন, রাজা গোপাল আচারিয়া, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ড.দীনেশচন্দ্র সেন, সরলাদেবী চৌধুরানী, নরেন্দ্রনাথ দেব, ড.নলিনী ভট্টশালী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ক্ষিতিমোহন সেন, কালীমোহন ঘোষ, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী, ত্রিপুরার মহারাজা মাণিক্য বাহাদুর, সরোজিনী নাইডু, হেমপ্রভা মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ দাস, ভীম ভবানী, রাম মূর্তি, এ.ভি. থাক্কার, প্রাণগোপাল গোস্বামী, রামদাস বাবাজী, ভোলানাথ গিরি, আলোক বাবা, মা আনন্দময়ী, শ্রীমং পুরুষোত্তমানন্দ অবধূত, শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার, শ্রীমৎ সমাধিপ্রসাদ আরণ্য, শ্রীমৎ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, প্যারীমোহন ভট্টাচার্য্য, ডাবলিউ. এম. ক্লার্ক, বিধূশেখর শাস্ত্রী, ড.নীহাররঞ্জন রায়, ড.ধীরেন্দ্রনাথ সেন, ড.সুধীর সেন, স্বামী প্রাণবানন্দ, সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খান, আইসিএস আলী ব্রাদার্স, মেজর এ.সি. চ্যাটার্জী, আচার্য এ.বি.কৃপালনি, সুচেতা কৃপালনি, মেঘনাদ সাহা, আনন্দশঙ্কর রায়, হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

এই মহেশাঙ্গনে স্বদেশী যুগের সম্মেলন, নিখিল বঙ্গ আইনজীবী সম্মেলন, অল বেঙ্গল পেট্রোল কনফারেন্স, অল বেঙ্গল পোস্টার কনফারেন্স, অল বেঙ্গল টিচার্স কনফারেন্স, ওলেমা কনফারেন্সসহ সর্ববিধ নিখিল বঙ্গ সম্মেলনের আদর্শ স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। তাছাড়া সেইসময় ভাগবৎ গীতাপাঠ, মিলাদ মাহফিল, ইসলামিক ওয়াজ মাহফিল, মুকুন্দ দাশের যাত্রাগান, রামকমল ভট্টাচার্য্যর কীর্তন, বৈষ্ণব সম্মেলন কতকিছু যে এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার ইতিহাস কে লিখবে?

সেইসময় নামকরা শিক্ষকরা ঈশ্বর পাঠশালায় শিক্ষকতা করেছেন। মহেশাঙ্গনের সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করেছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লার বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, তাঁরা হলেন, জাতীয় তথা কংগ্রেস নেতা অখিলচন্দ্র দত্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এ. রসুল, মথুরামোহন দেব, কৈলাশচন্দ্র দত্ত, রায়বাহাদুর ভূধর দাশগুপ্ত, কামিনীকুমার দত্ত, রায়বাহাদুর অনঙ্গমোহন নাহা, বিশ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল দাশ ভৌমিক, গোবিন্দ সাহা, রাখাল রায়, অতীন্দ্রমোহন রায়, যতীন ভদ্র, অক্ষয় পাল, অতীন্দ্রমোহন ভদ্র, অধ্যক্ষ রেজাউর রহমান (কুমিল্লার প্রথম ল কলেজ), মজিবুর রহমান, ডাঃ সুলতান আহম্মদ, আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী, ভুবন ধর, হাবিবুর রহমান, সুরেশ সিংহ রায়, প্রকাশ সিংহ রায় (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভাতৃদ্বয়), বসন্ত মজুমদার, গুরুদয়াল সিংহ, ঊর্মিলা সিংহ প্রমুখ। এছাড়া অধ্যাপকবৃন্দ, ব্যবসায়ীবৃন্দ, কুমিল্লা অভয় আশ্রমের নেতৃবৃন্দও মহেশচন্দ্রকে সর্বদা সমীহ করতেন এবং উৎসাহ দিতেন। বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠানটি পাকসেনাদের নির্ঘাৎ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে আইনজীবী রেজাউর রহমান, ডাঃ সুলতান আহম্মদ, আইনজীবী মজিবুর রহমান প্রমুখের বদৌলতে।

দানবীর মহেশচন্দ্র সম্পর্কে এইসব দুর্লভ তথ্য ইন্দ্রকুমার সিংহ প্রকাশ করে নতুন গবেষণার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন। মহেশচন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও গ্রন্থের শেষাঙ্গে সংযুক্ত আছে আরও তিনটি দুর্লভ প্রবন্ধ যথাক্রমে ‘কবি ও গীতিকার অজয়কুমার ভট্টাচার্য্য’, ‘বিরাগো সেট্ঠো ধম্মানং’ এবং ‘অদ্বৈতবাদ ও স্বামী বিবেকানন্দ।’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং পণ্ডিত ইন্দ্রকুমার সিংহ শেষোক্ত দুটি প্রবন্ধে তাঁর ধর্ম, মানবতা ও শান্তি সম্পর্কে যে গভীর জ্ঞানলব্ধ অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা নিয়ে কেউ এখন আলোচনা করেন না বলেই জরুরি এবং এটা অনুভব করেছেন বিধায় জীবনসায়াহ্নে এসে শাশ্বত সত্যকে বর্তমান প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন।

অবশিষ্ট প্রবন্ধটি অত্যন্ত মূল্যবান এই জন্য যে, বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশই বিস্তারিতভাবে জানে না কে শচীন দেববর্মণ বা অজয় ভট্টাচার্য্য? ৪০-৫০-৬০ এর দশকে সিনেমার গান ও কাহিনী লিখে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কবি ও সাহিত্যিক অজয় ভট্টাচার্য্য। তাঁর অনুজ কবি ও প্রাবন্ধিক সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য ১৯৩২ সালে কুমিল্লা থেকে সাড়াজাগানো সাহিত্য কাগজ ‘পূর্ব্বাশা’র প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। অজয় ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ত্রিপুরা রাজবংশের সন্তান সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেববর্মণ; অজয়ের লিখিত অনেক গানের সুর করেছেন আবার নিজেও গেয়েছেন। অজয় ভট্টাচার্য্য ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য উভয়েই ঈশ্বর পাঠশালার ছাত্র ছিলেন। তাঁরা যে এখনো কুমিল্লার গৌরব সেই ইতিহাস পুনরুদ্ধারে সংস্কৃতি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন গ্রন্থকার।

তবে প্রায় দু’শ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি বার্ধক্যজনিত কারণে লেখকের মনোযোগছিন্নতাবশত তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বেশ কয়েক জায়গায়। মুদ্রণ প্রমাদ বিস্তর হওয়াতে প্রতি পৃষ্ঠায় হোঁচট খেতে হয়। অথচ এ রকম মূল্যবান একটি গ্রন্থ যার সুসম্পাদনা ও প্রুফ না দেখার অবেহলা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন ঈশ্বর পাঠশালার প্রাক্তন ছাত্র স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী অধ্যাপক সমরজিৎ রায়চৌধুরী। প্রকাশকাল : আগস্ট ২০১১।

লেখক : জাপান প্রবাসী সাহিত্য গবেষক।