E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভারতীয় শাড়ির দখলে করটিয়া কাপড়ের হাট!

২০১৭ নভেম্বর ০৮ ১৫:৩৪:৫২
ভারতীয় শাড়ির দখলে করটিয়া কাপড়ের হাট!

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি বেচাকেনার করটিয়া হাট ভারতীয় শাড়িতে সয়লাব হয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও হাটের ইজারাদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চোরাই পথে ভারতীয় শাড়ি এনে টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে বিক্রি করছেন। ফলে বাঙালি রমণীর প্রিয় পোষাক জগৎখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।

জানা গেছে, করটিয়া জমিদারের মুতওয়াল্লী ওয়াজেদ আলী খান পন্নী তার পিতামহ (দাদা) সাদত আলী খান পন্নীর নামে ১৯২৬ সালে করটিয়ায় সাদত বাজার ও পিতা হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর নামে মাহমুদগঞ্জ হাট প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে মাহমুদগঞ্জ হাটটি করটিয়া হাট হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইল শাড়ির বিপণন কেন্দ্র হিসেবে করটিয়ার হাট দেশজুরে খ্যাতি অর্জন করে। করটিয়ার শাড়ির হাট বৃহস্পতিবার হলেও তা পিছিয়ে এসে এখন মঙ্গলবার বিকাল থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত চলে।

এতদাঞ্চলের তাঁতীরা বর্ণিল সুতা, জরি বুটি, পুঁতি দিয়ে নিপুণ হাতে অসাধারণ দক্ষতায় জামদানি, বেনারসি, কাতান ও তসরকে সাজিয়ে তোলেন। নিজস্ব ডিজাইনে খাঁটি সুতায়ও তৈরি করেন বহারি নামের শাড়ি। তারপর সেই শাড়িগুলো তোলা হয় টাঙ্গাইলের করটিয়া হাটে। জমকালো এসব শাড়ি সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা ভিড় করেন এ হাটে।

মূলত: ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির পাইকারি বাজার বলতে এক সময় সদর উপজেলার বাজিতপুর হাটকে বোঝাত। কালের পরিবর্তনে এখন ‘করটিয়ার হাট’ই টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য বিখ্যাত হয়েছে। কিন্তু কতিপয় ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় স্বল্পমূল্যের রঙচঙা নিন্মমানের ভারতীয় শাড়ি চোরাই পথে এ হাটে আমদানি করছে। ফল অধিক চাকচিক্যের ভারতীয় শাড়ি কিনে প্রতারিত হচ্ছে ক্রেতা সাধারণ এবং বিপণনে পিছিয়ে পড়ছে টাঙ্গাইল শাড়ি।

জেলার হাটগুলোতে ক্রেতা সমাগম ঘটলেও ভারতীয় শাড়ির ভিড়ে হতাশ হচ্ছেন দেশীয় বিক্রেতারা। ভারতীয় শাড়ির রঙ চক্চকে হলেও গুনে অত্যন্ত নি¤œমানের ও দামেও সস্তা। ক্রেতারা না বুঝে টাঙ্গাইল শাড়ি ভেবে তা কিনে প্রতারিত হচ্ছেন এবং ভারতীয় শাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কম মূল্যে শাড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে তাঁতীদের। ফলে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির কারিগরদের লোকশান বাড়ছে, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন তাঁতীরা।

করটিয়ার কাপড়ের হাটে গিয়ে দেখা যায়, এক সময়ের টাঙ্গাইল শাড়ির সবচেয়ে বড় এই বাজার এখন অনেকটাই ভারতীয় শাড়ির দখলে। হাটের প্রায় দেড় হাজার বিপণির স্থানীয় শাড়িকে টেক্কা দিতে হাটে উঠেছে রঙচঙা ভারতীয় শাড়ি। ৫০-৬০টি দোকানে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় শাড়ি। হেমন্তের শেষে শীতের আবহ থাকায় হাটে স্থান করে নিয়েছে ‘চাঁদর’। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী জেলায় তৈরি শীতের চাঁদর অত্যন্ত নিপুঁণ কারুকাজ ও রঙে সৌন্দর্যমন্ডিত। দেশীয় চাদরের বাজারও দখল করে নিয়েছে নিন্মমানের ‘ভারতীয় চাদর’।

হাটের কয়েক ব্যবসায়ী জানান, ভারতীয় সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তাকেই ক্রেতাদের মাঝে ভারতীয় শাড়ি গ্রহণযোগ্যতার প্রধান কারণ। পাশাপাশি কম খরচে বৈধ ও অবৈধভাবে শাড়ি আমদানির সুযোগ থাকায় অনেক ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যান।

করটিয়া হাটের তাঁত শাড়ি বিক্রেতা আবু বকর, আব্দুর রহিম, তারেক বাবু, ফরিদ আহাম্মেদ সহ অনেকেই জানান, কয়েক বছর ধরে দেশীয় শাড়ি শিল্পকে ভারত থেকে আনা শাড়ি ও অন্যান্য পোশাকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির বাজার নষ্টে ষড়যন্ত্র করছে। অতি মুনাফার লোভে একশ্রেণির ব্যবসায়ী ভিনদেশি ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ তাদের।

করটিয়ার হাটের শাড়ি কাপড় ব্যবসায়ী নারায়নগঞ্জের হাজী মো. লাল মিয়া জানান, বর্তমানে ৫০-৬০টি দোকানে অবাধে নিন্মমানের রঙচঙা ভারতীয় শাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। গাইবান্ধা জেলার ঠান্ডু(৪৫), জাহাঙ্গীর(৫৫) সহ কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়দের সহায়তায় মঙ্গলবার বিকালে করটিয়ার হাটে চোরাই পথে আনা ভারতীয় শাড়ির পসরা সাজায়। মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত হাটে ভারতীয় শাড়ির আধিক্য থাকে।

ভারতীয় শাড়ির আমদানিকারক গাইবান্ধা জেলার ঠান্ডু জানান, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে চোরাই পণ্য বলে কিছু নেই। সব দেশের সব পণ্য সকল বাজারেই বৈধ। সীমান্ত এলাকা পাড়ি দিয়ে দেশের ভিতরে আসা পণ্য অবৈধ হয়না। তাছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় মাসোহারা দিয়েই তিনি শাড়ি বিক্রি করেন। প্রতিমাসে প্রশাসনের প্রতিনিধিরা এসে মাসোহারা নিয়ে যায়।

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী খ্যাত পাথরাইলের শাড়ি ডিজাইনার ও পাইকারি বিক্রেতা যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং-এর স্বত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক জানান, ‘বিদেশি পণ্য, দেশীয় পণ্য থেকে ভালো’- এই মানসিকতা থেকে যদি আমরা বের হয়ে না আসতে পারি, তবে আমাদের দেশীয় পণ্যগুলো কালের অতলে হারিয়ে যাবে। আমাদের দেশে অনেক ভালো পণ্য তৈরি হয়। এমনকি ভারতে আমরা শাড়ি রপ্তানি করি। ভারতীয় নারীরা আমাদের তৈরি শাড়ি ভালো বলে বেশি ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের দেশের নারীদের ভারতীয় শাড়ির প্রতি বেশি আকর্ষণ। সেই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে নিন্মমানের শাড়ি এনে বাজার সয়লাব করছে। ফলে শাড়ি ব্যবসায় আমাদের টিকে থাকা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রবের দাম বৃদ্ধি পেলেও আমাদের দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় পোশাকের দাম অনেক কম। জগৎখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির দামও অনেক কম।

হাটের ইজারাদার ও করটিয়া ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর সিকদার জানান, তিনি হাট ইজারা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন- তারাই খাজনা আদায় সহ হাটের দেখাশোনা করে থাকে। কাপড়ের হাটে ভারতীয় শাড়ি বিক্রির বিষয়ে তিনি অবগত নন। টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য রক্ষায় ভারতীয় শাড়ির অনুপ্রবেশ বন্ধে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

(আরকেপি/এসপি/নভেম্বর ০৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test