E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিক্ষকদের ডেকে ইউএনও’র লেখা দেড় লাখ টাকার বাধ্যতামূলক বই বিক্রি!

২০২০ মার্চ ০৬ ১৭:১৫:১২
শিক্ষকদের ডেকে ইউএনও’র লেখা দেড় লাখ টাকার বাধ্যতামূলক বই বিক্রি!

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী পালনকে সামনে রেখে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় দেড়শ স্কুল, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিদের ডেকে ইউএনও’র মতবিনিময়ের ছদ্মাবরণে নিজের লেখা দেড় লাখ টাকার বই বাধ্যতামুলক বিক্রির অভিযোগ করেছেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ।

বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহ হল রুমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী রওশন ইসলাম এর সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী পালনের ছদ্মাবরণের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত, সরকারী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সরদার আকবর আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুনীল কুমার বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ মো.লিটন, থানা অফিসার ইন চার্জ মো.আফজাল হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মলিনা রানী রায়, রফিকুল ইসলাম তালুকদার, শিক্ষা অফিসার সিরাজুল হক তালুকদার, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নজরুল ইসলামসহ সরকারী কর্মকর্তা ও উপজেলার ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতিগন।

অনুষ্ঠিত সভা শেষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করার পরে নিজের লেখা দুটি বই ক্রয় করতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

সভা শেষে উপজেলার ৩৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি কলেজ, ৬টি স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ৬টি মাদ্রাসা, ১টি ভোকেশনাল স্কুল, ৯৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মোট ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ইউএনও চৌধুরী রওশন ইসলামের লেখা “প্রতিবিম্ব” ও “দৈনন্দিন গল্প” নামের ৫টি করে মোট ১০টি বই বাধ্যতামুলক কিনতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হয়। “দৈনন্দিন গল্প” বইটির গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ১৫০টাকা ও “প্রতিবিম্ব” বইটির মূল্য লেখা রয়েছে ১৩০টাকা। সে হিসেবে ১০টি বইর মূল্য দাড়ায় ১হাজার ৪শ টাকা। তবে শিক্ষকদের কাছে বাধ্যতামুলক বিক্রি করা ১০টি বইর মূল্য রাখা হয়েছে ১ হাজার টাকা। ১হাজার টাকার বই বিক্রির হিসেবে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দেড় লাখ টাকার বই কিনতে বাধ্য করেছেন ইউএনও।

নাম না প্রকাশের শর্তে বই কিনতে বাধ্য হওয়া একাধিক শিক্ষক বলেন, তারা ১হাজার টাকা দিয়ে বই কেনার জন্য কেউ প্রস্তুতি নিয়ে সভায় আসেন নি। ইউএনও’র নির্দেশনায় মানসম্মান আর চাকুরীর ভয়ে সহকর্মী, পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধার দেনা করে তারা বই নিতে বাধ্য হয়েছেন। ওই দিন যারা নিতে পারেন নি তাদের পরবর্তিতে নিতে হবে। জাতির পিতার শতবর্ষ উদযাপনের জন্য ডাকা সভায় ইউএনও’র নিজের লেখা বই কিনতেই হবে তা তারা জানতেন না।

শিক্ষকেরা অভিযোগে বলেন, ঘটনা করে শিক্ষকদের ডেকে তিনি (ইউএনও) নিজেকে কি প্রমান করতে চেয়েছেন তা শিক্ষকদের বোধগম্য নয়। স্ব-স্ব শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমেও মুজিব বর্স পালনের নির্দেশনা দেয়া যেত বলেও মন্তব্য করেন তারা।

তারা অভিযোগে আরও বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ি সরকারী সকল অফিস ও অডিটরিয়মে জাতির পিতা ও প্রধান মন্ত্রীর ছবি টাঙ্গানো বাধ্যতামুলক। স্থানীয়দের দীর্ঘ দিনের দাবীর মুল্যায়ন করে মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রচেষ্টায় আগৈলঝাড়ায় কোটি টাকা ব্যয়ে “শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহ” অডিটরিয়ম নির্মিত হলেও সেই অডিটরিয়মে বছর ঘুরেও ঠাঁই হয়নি জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রীর কোন ছবি। ’৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ঘাতকের বুলেটে জাতির পিতার সাথে শহীদ হওয়া মন্ত্রী পুত্র সুকান্ত আবদুল্লাহর নামে অডিটরিয়মের নাম করণ হলেও অডিটরিয়মে ঠাঁই মেলেনি শহীদ সুকান্ত আবদুল্লাহর কোন ছবি! মুলতঃ বই মেলা আর মুজিব বর্ষ পালনের ছদ্মাবরণে ইউএনও’র বাধ্যতামুলক বই বিক্রিই ছিল মত বিনিময় সভা ডাকার মূল উদ্যেশ্য।

অডিটরিয়মে জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রীর ছবি না থাকায় শিক্ষকদের সাথে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতার পক্ষের স্থানীয় সাধারণ জনগনও।

ইউএনও চৌধুরী রওশন ইসলামের পূর্বের কর্মস্থল চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা অডিটরিয়মেও তিনি জাতির পিতা ও প্রধান মন্ত্রীর ছবি রাখা আবর্শক মনে করেন নি। যার বহু প্রমান পাওয়া গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ইউনও চৌধুরী রওশন ইসলাম এর লেখা একটি বই একুশের জাতীয় বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়। তার লেখা ওই বই বিক্রির জন্য ইউএনও রওশন ইসলাম কৌশলে উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাক্তিকে কৌশলে ম্যানেজ করে বই বিক্রির জন্য আগৈলঝাড়ায় কৌশলে এ বছর সরকারী খরচে বই মেলার আয়োজন করেন। প্রথমে এক দিনের জন্য বই মেলা অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও ইউএনওর লেখা বই আশাতীত বিক্রি না হওয়ায় সরকারী খরচে নিজের লেখা বই বিক্রির জন্য মেলা বর্ধিত করে তিন দিন চালানো হয়।

নাম না প্রকাশের শর্তে উপজেলার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ ফ্রেব্রুয়ারী। অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি সভায় আগৈলঝাড়ায় বই মেলা সম্পর্কে ইউএনও কোন কথাই উত্থাপন করেন নি। কৌশলী ইউএনও ১৬ ফেব্রুয়ারী রাতে স্থানীয় এমপি’র বাস ভবনে সরকারী উন্নয়ন কাজের জন্য তার সাথে দেখা করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে এমপিকে বলে কৌশলে বই মেলা করার অনুমতি নিয়ে নেন। নিজের লেখা বই বিক্রির জন্য ঘটা করে সরকারী খরচে আয়োজন করেন বই মেলার।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী রওশন ইসলাম শিক্ষকদের কাছে বাধ্যতামুলক বই বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি শিক্ষকদের বলেছেন তার লেখা বই যদি কেউ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তবে তারা নিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকেরা তার লেখা ৬/৭শ বই চেয়ে নিয়েছেন বিক্রি করে দেয়ার জন্য। তাদের বই দেয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে বই সংরবরাহ করা হয়েছে। যদি কোন শিক্ষককে বই কিনতে বাধ্য করা হয় সেটা করেছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা।

অডিটোরিয়মে জাতির পিতা ও প্রধান মন্ত্রীর ছবি না রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, ছবি না টানানোর কারনে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হয়নি। অডিটোরিয়মে ছবি না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, জাতির পিতা ও প্রধান মন্ত্রীর ছবি টানানোর বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন।

শিক্ষক সমিতির সভাপতির উপর ইউএনর’র বাধ্যতামুলক বই বিক্রির দায় চাপানোর বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক সমিতির সভাপতি সুনীল কুমার বাড়ৈ বলেন, ইউএনও তার লেখা বই যাদের পছন্দ হয় তাদের সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। তার কথানুযায়ি শিক্ষকদের বই সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। মাধ্যমিক স্তরের কোন শিক্ষককে বই কিনতে বাধ্য করা হয়নি। প্রাথমিক স্তরে কি হয়েছে তা তিনি জানেন না জানিয়ে অডিটোরিয়মে জাতির পিতা ও প্রধান মন্ত্রীর ছবি না থাকার বিষয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

(টিবি/এসপি/মার্চ ০৬, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test