E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

আশাশুনিতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব

দলে দলে এলাকা ছাড়ছেন আশ্রয় জীবিকা হারানো মানুষ!

২০২১ জুন ০২ ১৯:২২:৩০
দলে দলে এলাকা ছাড়ছেন আশ্রয় জীবিকা হারানো মানুষ!

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইরউনিয়নের শ্রীপুর লঞ্চঘাট এলাকার নরেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে তৃপ্তি মোহন দাস (৫০)। তালতলা বাজারে জুতো সেলাই করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। বড় ছেলে হীরালাল দাস প্রতাপনগর ইউনাইটেড একাডেমীতে নবম শ্রেণীতে ও ছোট ছেলে জয় একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশুনা করতো। 

সিডোর, আইলা, আম্ফান, বুলবুল, ফণির আঘাতে কপোতাক্ষের পারের পৈতৃক ভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। ইয়াশের প্রভাবে এখন বসতঘরের মধ্যে জোয়ারে পানি উঠলে বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিতে হয়। ভাটায় পানি কমলে ঘরে যেয়ে রান্না বান্না করতে হয়। নামমাত্র ত্রাণ পেয়েছেন। তাতে এক বেলা জোটে তো অপর বেলা জোটে না। এখন বেড়িবাঁধ করার জন্য কোন প্রকার নোটিশ না দিয়েই তাদেরকে আশ্রয়হীন করা হচ্ছে।

তালতলা বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আর লোকজন আসে না। তাই সাত পুরুষের আশ্রয় ও ব্যবসা হারিয়ে দু’ সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে শনিবার বাগেরহাটের মঙ্গলা থানাধীন দ্বিগরাজে একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে রাস্তার ধারে জুতো সারাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। করোনার কারণে এখন স্কুল খোলা না থাকলেও আগামিতে ছেলে দু'টোকে আর পড়াশুনা করাতে পারবেন না বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। সরকার যদি প্রতাপনগরকে দুর্গত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে এলাকার মানুষকে আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে তাদেরকে এত চরম দুর্দশার মধ্যে পড়তে হতো না বলে মনে করেন তৃপ্তি দাস। প্রতাপনগরের তালতলা বাজারের শামীম পারভেজ। শ্যামনগরে একটি এনজিওতে কাজ করেন। বুধবার দুপুরে প্রতাপনগর এপিএস কলেজের পাশের ভাঙা রাস্তা নৌকায় পার হওয়ার সময় কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে।

হতাশার মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে স্বপরিবারে শ্যামনগরের বাধঘাটায় যাচ্ছেন উল্লেখ করে বলেন, এ যাত্রা হয়তো শেষ যাত্রা। যেখানে বার বার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্চ্বাসে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা যায় না সেখানে থাকা নিরাপদ হবে কি? ইয়াশের প্রভাবে ঘরের মধ্যে জোয়ার ভাটা খেলার দৃশ্য মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মনে থাকবে উল্লেখ করে শামীম পারেভজ বলেন, যারা চেয়ারম্যানের লোক তারা সরকারি ত্রাণ পাচ্ছে। যাদের ভোট চেয়ারম্যান পাননি বলে মনে করেন তাদের কপালে ত্রাণ তো দূরের কথা, এক গ্লাস সুপেয় পানিও জুটছে না। এরপরও কি এখানে বাস করা যায়?

প্রতাপনগর গাজী বাড়ির ইসলাম গাজীর ছেলে অজিহার গাজী। চিংড়ি ঘের করেই সংসার চলতো। ২০২০ সালের আমফানে ভেসে যাওয়া চিংড়ি ঘেরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। শোধ করতে পারেননি মহাজনের টাকা। আবারো সুদ করে এবছর বাগদার পোনা ছেড়েছিলেন। ইয়াসের প্রভাবে কপোতক্ষের বাঁধ ভাঙা পানিতে আবারো ভেসে গেলে ঘের। তাই শুধু মাত্র দুটো ভাতের জালায় চলে যাচ্ছেন খুলনায়। হয়তোবা ইজিবাইক বা মোটর ভ্যান চালানো ছাড়া উপায় নেই।

একইভাবে কুড়িকহিনিয়া গ্রামের মোক্তার গাজীর ছেলে তালতলা বাজারের এলুমিনিয়াম ও স্টীলের বাক্স নির্মাতা মিলন গাজী একের পর এক দুর্যোগের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে দু’দিন আগে চলে গেছেন আশাশুনির মাড়িয়ালা গ্রামে। একইভাবে কুড়িকাহনিয়ার আফিলউদ্দিন গাজীর ছেলে স’ মিলের কর্মী আইয়ুব গাজীর ঘর ইয়াশের প্রভাবে কপোতক্ষের জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাওয়ায় স্বপরিবারে চলে গেলে যশোরের কেশবপুর উপজেলায়।

একই গ্রামের রহমান গাজীর ছেলে রুবেল গাজী স্বপরিবারে খুলনায়, গোলাপ গাজীর ছেলে পরিচ্ছন্ন কর্মী কালাম গাজী, ফরমান গাজীর ছেলে দিনমজুর খোকন গাজীও পরিবার পরিজন নিয়ে চলে গেছেন খুলনায়। ইসলাম গাজীর ছেলে ব্যাংকার লুঃফর গাজী চাকুরি করেন শ্যামনগরে। উপায়ান্তর না থেকে স্বপরিবারের কর্মস্থলের পাশে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। খুলনার একটি হাইস্কুলে চাকুরি করার সুবাদে কুড়িকাহনিয়ার সাঈদুজ্জামান মঙ্গলবার স্ত্রী কাজুরি পারভিন ও দু’ সন্তানকে নিয়ে কর্মস্থলের পাশে বাসা ভাড়া নিয়েছেন।

একইভাবে কুড়িকাহনিয়ার আনছার ঢালীর ছেলে শ্রীপুর বাজারের মুদি দোকানী আক্তারুল ঢালী স্বপরিবারে খুলনায় যেয়ে ফুটপাতে চা, পান ও বিড়ি বিক্রি করছেন। এ অবস্থা শুধু শ্রীপুর বা কুড়িকানিয়াতে নয়। গোটা প্রতাপনগর ইউনিয়ন জুড়ে একই চিত্র বিরাজ করছে বলে জানালেন বিশিষ্ঠ সমাজসেবক নূরে আলম ছিদ্দিকি।

তিনি আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন, জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারণে সুন্দরবন উপকুলবর্তী অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারি মানুষজনের বসবাস করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সে কারণে আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনীসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের লাখো পরিবার আজ হুমকির মুখে সাত পুরুষের ভিটা ছাড়তে চলেছেন। এদের রক্ষায় সরকার দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প হাতে না নিলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ওইসব অঞ্চল।

একইভাবে জীবন জীবিকা রক্ষায় নতুন কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থানে যেয়ে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করতে না পেরে অনেকেই হারিয়ে ফেলবেন তাদের স্বাভাবিক জীবন ও পারিবারিক বন্ধন। তিনি বলেন, একে বসত বাড়িতে জোয়ার ভাটা খেলছে , অন্য দিকে ঘরে খাবার নেই। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। সুপেয় পানির আঁধার নষ্ট হওয়ায় লোনা পানি খেয়ে পেটের পীড়ার পাশপাশি মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে পানি বাহিতে রোগে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ গবাদিপশু নিয়ে এক জায়গায় থাকতে হচ্ছে।

বিশিষ্ঠ সমাজসেবক অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, বার বার ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষজনকে বাঁচিয়ে রাখতে চলতি বাজেটে সাতক্ষীরাকে উপদ্রুত এলাকা হিসেবে ধরে নিয়ে মেঘা প্রকল্প হাতে নেওয়া ছাড়া সরকারের কোন বিকল্প নেই। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মাণ করতে হবে সাতক্ষীরার ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এ প্রকল্পে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

(আরকে/এসপি/জুন ০২, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test