E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে বালুখেকোদের থাবা, থানায় দায়সারা অভিযোগ

২০২১ সেপ্টেম্বর ০৯ ১৮:০৩:৫২
বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে বালুখেকোদের থাবা, থানায় দায়সারা অভিযোগ

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : বুড়িগঙ্গা নদী (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ রিভার সিস্টেম) পুনরুদ্ধার প্রকল্পের টাঙ্গাইল অংশে বালুখেকোদের থাবা পড়েছে। একদিকে বালু ব্যবসায়ীরা অধিগ্রহনকৃত জায়গা দখল করে বালুর পাহাড় গড়েছে। অন্যদিকে পাউবো কর্তৃক ড্রেজড ম্যাটার অর্থাৎ উত্তোলিত বালু ট্রাক ও নৌকাযোগে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে ওই প্রকল্পের কাজে বিঘ্ন ঘটছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম বাদি হয়ে থানায় অভিযোগ দাখিল করেছেন। কালিহাতী থানায় দায়েরকৃত অভিযোগে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১১ বছর আগে এক হাজার ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা নদী(নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ রিভার সিস্টেম) পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের যমুনা তীরবর্তী বেলটিয়া, বিনোদ লুহুরিয়া, শ্যামশৈল এলাকায় গাইড বাঁধ নির্মাণ ও সেডিমেণ্ট বেসিন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যমুনা নদীর পানি নিউ ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশাই, তুরাগ হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর প্রবাহকে সচল রেখে দূষণ রোধ করবে।

থানায় দাখিলকৃত অভিযোগে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ রিভার সিস্টেম) পুনরুদ্ধার প্রকল্পের টাঙ্গাইল অংশে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখ(অফটেক) বাঁধাই করা হচ্ছে। এছাড়া কালিহাতী উপজেলার বেলটিয়াবাড়ি এলাকায় একটি সেডিমেণ্ট বেসিন নির্মাণের জন্য প্রায় ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বর্তমানে সেডিমেণ্ট বেসিন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। অধিগ্রহণের এক বছর পর থেকে গোহালিয়াবাড়ী ইউপি সদস্য মো. আব্দুল হাই আকন্দের(ছোট হাই) নেতৃত্বে একটি মহল ওই জমি দখল করেছে। সেখানে তারা বড় বড় নৌযান(বাল্কহেড বা বলগেট) দিয়ে বালু এনে স্তুপ করে রাখছে।

এদিকে, নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখ থেকে জোকারচর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় পাউবো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে। উত্তোলিত বালু নদীর দুই তীরে দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রির জন্য স্তুপ করে রাখা হয়। নদীতীরের কুর্শাবেনু, বেলটিয়া, বিনোদ লুহুরিয়া ও জোকারচর থেকে ওই বালু প্রকাশ্যে অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। ওই বালু বিক্রি করছেন গোহালিয়াবাড়ী ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম, গোহালিয়াবাড়ী গ্রামের আমিনুর, নোমান, আইয়ুব আলী, আশরাফ আলী ও কুর্শাবেনু গ্রামের রফিক সহ ১০-১২ ব্যক্তি। তারা প্রকাশ্যে নদীতীর থেকে ড্রেজড ম্যাটার ট্রাক ও নৌকাযোগে বিক্রি করছেন। টাঙ্গাইল পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম থানায় দাখিলকৃত অভিযোগে ড্রেজড ম্যাটার চুরি করে বিক্রির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। অথচ কোটি টাকা মূল্যের ড্রেজড ম্যাটার বিক্রি করায় সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সরেজমিনে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার পাশ দিয়ে গ্যাসপাইপ লাইনের উপর দিয়ে একটি রাস্তা নদীর তীরে প্রকল্প এলাকায় চলে গেছে। ওই রাস্তা ব্যবহার করে ট্রাক দিয়ে বালু পরিবহন করেন ব্যবসায়ীরা। অধিগ্রহণ করা জায়গায় বালুর বিশাল বিশাল স্তুপ দেখা যায়। তার পাশেই নদীতে বড় বড় বাল্কহেড বাঁধা রয়েছে। ড্রেজার দিয়ে তা থেকে বালু তুলে স্তুপ করা হচ্ছে। বাল্কহেডগুলো চলাচলের কারণে নদীতে সৃষ্ট ঢেউয়ে নদীতীর ভেঙে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে। পাউবো কর্তৃক উত্তোলন করে রাখা ড্রেজড ম্যাটারের(বালু) ঢিবি গুলো ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে। ট্রাক দিয়ে সড়ক পথে ও নৌকা দিয়ে নদী পথে ড্রেজড ম্যাটার(বালু) বিক্রি করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী গত ১০ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করেন। আবেদনে তিনি বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অনুমতি চান। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২৪ আগস্ট গোহালিয়াবাড়ী ইউপি সদস্য মো. আব্দুল হাই আকন্দকে সতর্ক করে বালু সরিয়ে নিতে চূড়ান্ত নোটিশ দেয়।

গোহালিয়াবাড়ী ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সম্পাদক আ. হাই আকন্দ(ছোট হাই) জানান, তারা সিরাজগঞ্জের মহাল থেকে বালু কিনে নৌযান(বাল্কহেড) দিয়ে আনছেন। বালু এনে তারা বিনোদ লুহুরিয়া এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় স্তুপ করে বিক্রি করছেন। ঢিবি(বালুর পাহাড়) বড় হওয়ায় বৃষ্টিতে সামান্য কিছু বালু অধিগ্রহনকৃত জায়গায় পড়েছে। চিঠি পাওয়ার পর তারা অধিগ্রহনকৃত জায়গার বালু সরিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি আরও জানান, টাঙ্গাইল পাউবো তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন- তা ভূঞাপুরের বালু বিক্রেতাদের পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে করেছেন।

গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান ও কালিহাতী উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হযরত আলী তালুকদার জানান, পাউবো প্রায় চার কোটি ঘনমিটার ড্রেজড ম্যাটার উত্তোলন করে নদীতীরে জমা করে রেখেছিল। উত্তোলিত ড্রেজড ম্যাটারের তিন চতুর্থাংশ ইতোমধ্যে অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছে। টাঙ্গাইল পাউবো’র যোগসাজস ছাড়া প্রকাশ্যে এভাবে সরকারি মালামাল বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অলিখিত সমন্বয়ে স্থানীয় ১০-১২ ব্যক্তি ওই বালু বিক্রি করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

কালিহাতী থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মোল্লা মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী একটি দায়সারা অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি কারো নাম উল্লেখ করেন নি, কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা লিখেন নি। অভিযোগটি তদন্তের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বুড়িগঙ্গা নদী (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের টাঙ্গাইল অংশে নিউ ধলেশ^রী নদীমুখ(অফটেক) দিয়ে বড় নৌযানের(বাল্কহেড/ভলগেট) মাধ্যমে বালু পরিবহন ও মজুদ করায় প্রকল্পটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় বুধবার(৮ সেপ্টেম্বর) জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ঘটনাস্থলে কাউকে না পাওয়ায় ভ্রাম্যমান আদালত কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। তবে ভ্রাম্যমান আদালত পাউবোকে নিয়মিত মামলা দায়ের করার জন্য অনুরোধ করেন। তারই আলোকে কালিহাতী থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

(আরকেপি/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test