E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কমরেড শেখ রওশন আলি’র ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

২০১৪ সেপ্টেম্বর ১৭ ১৩:০২:৩৬
কমরেড শেখ রওশন আলি’র ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : উপমহাদেশের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা কমরেড শেখ রওশন আলি’র  ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৪ সালের  এইদিনে লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের এক কেবিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিন তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে, এক বিষন্ন কালো মেঘে আচ্ছন্ন করে কুষ্টিয়াবাসিকে। নেমে আসে সর্বত্র শোকের ছায়া। কমরেড শেখ রওশন আলির জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ জুলাই কুষ্টিয়া শহরের আমলা পাড়ার হতদরিদ্র এক মাংশ বিক্রেতার ঘরে। বাবা এলাহী বকস, মা মতিজান নেছা বিবি।

পাঁচ বছর বয়সে রওশন আলি স্থানীয় খ্রিষ্টান মিশনারী প্রাইমারি সি,এম,এস, স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু অনটনের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর বেশী অগ্রসর হতে পারেননি। ১১ বছর বয়সেই একটি রুটি তৈরীর কারখানায় সহযোগি শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দেন। খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে খেলার দল গঠন করেন কিশোর রওশন আলি। এক সময় তিনি সহ কর্মীদের নিয়ে সার্কাস দল তৈরী করেন। শ্রমিক হিসাবে ১৯৩২ সালে তিনি মোহিনী মিলে কাজে যোগ দেন। তার দু’বছর পর কুষ্টিয়ার মোল্লাতেঘোরিয়া গ্রামের সদু ফকিরের বারো বছর বয়সী মেয়ে গোলাপি নেছা বিবি’র সাথে তাঁর বিয়ে হয়। এরপর ১৯৪২ সালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তাঁর স্ত্রী মারা যান। এর একবছর পর ছোটো ছেলে চুন্নু নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। চার দিনের ব্যবধানে মারা যান কমরেড শেখ রওশন আলির মা মতিজান নেছা বিবি। এবং এর নয় দিন পর বাবা এলাহি বকস প্যানিসাস ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন সংগঠিত করার অপরাধে তখন তিনি কারাবন্দী। আর কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার একান্ত আপনজনদের মৃত্যু তাঁকে প্রচন্ড ব্যাথিত করলেও হতদ্যম করতে পারেনি। তার বড় প্রমান তিনি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ও কখনো আদর্শচ্যুত হননি। সারাটা জীবন তিনি নিজেকে মেহনতী মানুষের আন্দোলন সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছেন। কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে কমরেড শেখ রওশন আলি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে যেমন তিনি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন, সাণিত করেছেন, ঠিক তেমনি সার্কাসের রিং মাষ্টরের পেটানো মজবুত শরীর নিয়ে মালিক পক্ষের গুন্ডাদের আক্রমণ থেকে অনেক কমরেডের জীবন বাঁচিয়েছেন। আবার অন্য দিকে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত কমরেড শেখ রওশন আলি ত্রি-পক্ষীয় বৈঠকে যুক্তির জোড়ে শ্রমিকদের দাবি আদায় করেছেন। ১৯৪৩ সালে কৃষ্ণনগর শহরে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটির মিটিং ভন্ডুল করার জন্য ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা অগ্রসর হলে তিনি তার লোহার মতো পেটানো শরীর নিয়ে গুন্ডাদের প্রতিহত করেন। তারপর থেকে কৃষ্ণনগর শহরে শেখ রওশন আলিকে দেখলেই গুন্ডারা পালিয়ে যেতো। এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটে ১৯৪২ সালের ১ মে তারিখে। শ্রমিক নেতা পূর্ণপাল ও শেখ রওশন আলি মিটিংয়ের প্রচার কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন। মিল মালিকের ৮ থেকে ১০ জন তাঁদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। শেখ রওশণ আলির বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং সাহসের কারণে তাদের জীবন রক্ষা পায়। ১৯৩৩ সালে ভারত বর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করার পর থেকে মূলত তার রাজনৈতিক জীবনের ব্যপ্তি শুরু হয়। এগারো বছর বয়সে তাঁর শ্রমিক জীবনের শুরু। আর সেখান থেকে তার উত্তোরণ ঘটে ১৯৩৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে। সেই উত্তোরণের ধারাবাহিকতায় তিনি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানীসহ বেশ কিছু দেশ সফর করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হয়ে। ১৯৩৪ সালে কমরেড শেখ রওশন আলি’র একান্ত প্রচেষ্টয় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘‘মোহিনী মিল সূতাকল মজদুর ইউনিয়ন’’। সূতাকল মজদুর ইউনিয়নের নতৃত্বে মোহিনী মিলে অনেক বড় বড় আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। যার নীতি নির্ধারনে এবং মূল নেতৃত্বে ছিল কমরেড শেখ রওশন আলির বিশাল ভুমিকা। ১৯৩৬ সালে এ রকম একটি যুগান্তকারি আন্দোলন গড়ে ওঠে মোহিনী মিলে। যার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। মালিক পক্ষ তাঁকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে এলে সাধারণ শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারপর সাত দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনের কর্মসুচি ঘোষনা করে। মালিকপক্ষ সাতদফা দাবির প্রতি অনমনীয় মনোভাব দেখালে শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৩৭ সালে শ্রমিকরা দীর্ঘকালীন ধর্মঘটে যায়। দুইমাস দশদিন একটানা ধর্মঘট চলার পর মালিক পক্ষ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আন্দোলনের সফলতার খবর সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লে কমরেড শেখ রওশন আলি হয়ে ওঠেন শ্রমিক শ্রেণীর কিংবদন্তী নেতা। ১৯৪৩ সালে সারা বাংলায় দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। নাখেয়ে হাজার-হাজার মানুষ মারা যেতে থাকে। কমরেড শেখ রওশন আলি তার বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সাহায্য তুলে লঙ্গরখানা খুলেছেন কুষ্টিয়া শহরে। এমনকি সেইসব সাহায্য তিনি দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও পাঠিয়েছেন নাখাওয়া মানুষের জন্য। তিনি ধাঙর ইউনিয়ন গঠন করে সমাজের অবহেলিত এই মানুষদের নিয়েও আন্দোলন সংগ্রাম করে তাদের দাবি আদায় করেছেন। তিনি গাড়োয়ানদের নিয়ে গাড়োয়ান সমিতি গঠন করে তাদের চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। তেভাগা আন্দোলনসহ কৃষকদের সকল আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল নেতৃস্থানীয়। সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ‘‘রওশন ভাই’’। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন সকল বিষয়েই কুষ্টিয়াতে তার সক্রিয় অংশগ্রহন কিম্বা সঠিক পথ নির্দেশনা আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতো। আয়ুব খানের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে তোলে ঐক্য জোট। নাম দেয়া হয় ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক)। কুষ্টিয়াতে ডাক গঠনে কমরেড শেখ রওশন আলি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে তাদের অনুপ্রাণিত করতেন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউসে কমরেড শেখ রওশন আলিকে ডেকে নিয়ে একান্তে আলাপ করেন। আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, রওশন ভাই আপনার অনেক গল্প শুনেছি, আপনি আমার কাছে কি চান। বিনয়ের সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের জন্য কিছু করুন। তাহলেই আমার সব পাওয়া হবে। গত ২০০৩ সালে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে কমরেড শেখ রওশন আলির অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ (বিআইএলএস) মহান মে দিবস-২০০৩ সম্মানণা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে।

(কেকে/এইচআর/সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test