E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দেবহাটায় পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া বাবলুর ন্যয় বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা

২০২১ ডিসেম্বর ২৭ ১৯:০৫:৫০
দেবহাটায় পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া বাবলুর ন্যয় বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ফেনসিডিলসহ আটকের অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকাকালিন অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার ১৫ দিন পরেও ন্যয় বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা সদর ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বাবলু সরদারের পরিবারের সদস্যদের।

১২ ডিসেম্বর ভোরে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে বাবলু সরদারের মৃত্যু হলেও ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় আটকের সাড়ে সাত ঘণ্টা পর দেবহাটা থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ বি(২) ধারায় মামলা দেখানো, বাবলু সরদারকে আটকের সময় তার ছেলে আল আমিনের ঘরের শোকেস থেকে পুলিশের সংগৃহীত ৩৫ হাজার টাকার কথা জব্দ তালিকায় না থাকা, সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃতের পিঠের দু’পাশে থাকা বিশেষ দাগের কথা উল্লেখ না থাকা এবং কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের বৈচানা গ্রামের মাহাবুবর রহমানের মেয়ে মাদক ব্যবসায়ি ও পুলিশের সোর্স মুন্নি খাতুনকে (২৮) গ্রেপ্তার না করায় মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন না হওয়ার এ আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ি বিজিবি সদস্য আব্দুর জব্বার হত্যা মামলার অন্যতম আসামী কমপক্ষে দু’ ডজন মামলার আসামী পরাজিত ইউপি সদস্য আরমান হোসেন ও জেলা পরিষদ সদস্য আল ফেরদৌস আলফার ভূমিকা ও প্রশ্নবিদ্ধ।

বসন্তপুর গ্রামের বাবলু সরদারের ছেলে আল আমিন জানান, তিনি জেল হাজতে থাকাকালিন তার বাবাকে ৫০ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও উপপরিদর্শক এমদাদ হোসেন। পরদিন ভোরে তার বাবা গোয়েন্দা পুলিশের গারদখানায় জানালার রডের সঙ্গে কোমরের ঘুনসি (কড সূতা) জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছে মর্মে পুলিশ তাদেরকে অবহিত করে তার স্ত্রী, মা ও বোনের কাছ থেকে কয়েকটি কাগজে সাক্ষর করে নেয়। বাবার একটি পা ও একটি হাত মোড়ানো অবস্থায় দেখতে পায় বড় ভাই শাহীনুর। সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে ময়না তদন্ত শেষে বাবার লাশ স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ওইদিন তার মা শাহানারার হাতে ১০ হাজার টাকা সহায়তা হিসেবে দেন জেলা পরিষদ সদস্য আল ফেরদৌস আলফা।

১৩ ডিসেম্বর তারা জানতে পারেন যে তার বাবাকে ৫০ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১১ ডিসেম্বর দেবহাটা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলামের দায়েরকৃত মামলাটি(৬নং, জিআর-১২৪/২১) ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় রেকর্ড দেখানো হলেও জব্দ তালিকায় পুলিশের নিয়ে যাওয়া ৩৫ হাজার টাকার কথা উল্লেখ নেই। এমনকি পানি পান করার কথা বলে তাদের বাড়িতে এসে ফেনসিডিলের ব্যাগ ফেলে যাওয়া সদরের চৌবাড়িয়া গ্রামের মাদক ব্যবসায়ি মুন্নি খাতুনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে কর্তব্যে অবহেলার কারণে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি উপপরিদর্শক শেখ সোহেল রানা ও সিপাহী শরিফুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে মর্মে তিনি জেনেছেন।

আল আমিন আরো জানান, গত ১৭ ডিসেম্বর বাড়িতে বাবার মিলাদ দেওয়া হয়। ওই দিন তাদের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদ সদস্য আল ফেরদৌস আলফা ও মাদক ব্যবসায়ি আরমান হোসেন। ওই দিনই কোন ঝামেলা না করার শর্তে আলফা তাকে এক লাখ টাকা দিয়ে একটি বসত ঘর বানিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। সে অনুযায়ি ওইদিন থেকেই আলফা ভাইয়ের অর্থায়নে ও আরমান মেম্বরের তত্বাবধরায়নে তার ঘর নির্মাণ শুরু হয়। ঘরটি পিলার বিহীন যেন তেন প্রকারে তৈরি হওয়ায় নদী তীরের ঝড়ো হাওয়ায় তা চাপা পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। তবে গত ২১ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের তিন সদস্যের তদন্ত টিম ও পরদিন খুলনা উপমহা পুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়ের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বাধীন তদন্ত টিম তাদের বাড়িতে ঘটনার তদন্তে আসেন। তদন্তকারি টিমের সদস্যদের কাছে তিনি ও পরিবারের সদস্যরা তার বাবার অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিচার দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাতক্ষীরা সদরের ভোমরা ইউনিয়নের চৌবাড়িযা গ্রামের কয়েকজন প্রবীন জানান, তাদের এলাকাটি মাদক জোন হিসেবে জেলা ও জেলার বাইরে পরিচিত। এখানে মাহাবুবর রহমানের ছেলে আহসান হাবিব, মজিদ, হবি ও মেয়ে মুন্নি কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ি । তারা র‌্যাব ও পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে অন্যদের ফাসিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যবসা করে থাকে। মুন্নির সঙ্গে কয়েক বছর আগে ঢাকার বাবু নামের এক ব্যক্তির বিয়ে হলেও সে ঘর করেনি। বসন্তপুরের আরমান মেম্বরের সঙ্গে তাদের মাদক ব্যবসা চলে বলে জানান তারা।

সাতক্ষীরার কয়েকজন বিশিষ্ঠ ব্যক্তি জানান, ২০১৩-১৪ সালে গোয়ন্দা পুলিশে কাজ করার সুবাদে সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছিল কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এতে পুলিশের ভাবমুর্তিও নষ্ট হয়েছিল। সেই সময়কার গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত থাকা উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও সিপাহী কবীর আবারো গোয়েন্দা পুলিশে, উপপরিদর্শক মঞ্জু ও সহকারি উপপরিদর্শক জিয়্ া(সদর থানায়), উপপরিদর্শক মিজানুর রহমান শ্যামনগর থানায় কিছুদিন আগে যোগদান করেছেন। বাবলু সরদারকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলামের ভূমিকা ও সম্প্রতি শহরের মাষ্টারপাড়ার মা মোটরস এর মালিক জিল্লুর রহমানসহ পাঁচজনকে পরিকল্পিত চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া নিয়ে নতুন করে আলোচিত হচ্ছেন সদর থানার উপপরিদর্শক মঞ্জু। বিষয়টি পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার আশা করছেন তারা। তারা কোন মতেই সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের সম্মান নষ্ট না হওয়ার জন্য আহবান জানান।

সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য আল ফেরদৌস আলফা বলেন, বাবলু সরদার একজন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান। তাই তার মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন মানবিক কারণে তার পরিবারকে সামান্য আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি ছেলে আল আমিনকে ব্যক্তিগতভাবে এক লাখ টাকা দিয়ে একটি আশ্রয়স্থল বানিয়ে দিচ্ছেন। এলাকার মানুষকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে সহায়তা করে থাকেন আল আমিনের ঘর দেওয়াটা একই প্রকারের। তিনিও মৃত্যুর সঠিক তদন্ত দাবি করেন।
দেবহাটা সদরের সদ্য পরাজিত ইউপি সদস্য আরমান হোসেন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি একজন দরিদ্র হিসেবে বাবলু সরদারের পরিবারের পাশে রয়েছেন।

বিশিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. সাঈদুর রহমান বলেন, ৫০ বোতল ফেনসিডিলসহ বাবলু সরদারকে ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় গ্রেপ্তার হলেও মামলায় দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে গ্রেপ্তার দেখানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে অনুযায়ি বিকেল সাড়ে ৫টায় মামলা রেকর্ডের পরপরই আসামী বাবলু সরদারকে নিয়ম অনুযায়ি দেবহাটা থানায় সোপর্দ করার কথা। কিন্তু সেটা না করে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রাখাটা আইনের পরিপন্থি। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ফলে মৃত্যু না হলেও যদি আত্মহত্যাও করে থাকেন বাবলু সরদার সেক্ষেতে মৃতের পরিবারের সদস্য ছাড়াও নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইন ২০১৩ এর (কার্যকর- ২৭ অক্টোবর-২০১৩) ৬(১) ধারায় কোন ব্যক্তিকে অন্য কোন ব্যক্তি নির্যাতন করিয়াছে/ করিতেছে এইরুপ কোন তথ্য তৃতীয় কোন ব্যক্তি আদালতকে অবহিত করিবে। আদালত ৫ ধারা মোতাবেক আবেদনকারির বিবৃতির উপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়া উক্ত ব্যক্তিকে নিরাপত্তা বিধান করিবে। প্রয়োজনে ৬(২) ধারা অনুযায়ি আদালত ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করিতে পারিবে।

প্রসঙ্গত, বাবলু সরদারের মৃত্যুর বিষয়টি ১২ ডিসেম্বর পুলিশের পক্ষ থেকে আত্মহত্যা বলে সাংবাদিকদের কাছে এক প্রেস ব্রিফিং করা হয়। একইসাথে কর্তব্য অবহেলার দায়ে সহকারি উপপুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা ও সিপাহী শরিফুল ইসলামকে বরখাস্তের কথা বলা হয়।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ২৭, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test