E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অর্ধকোটি টাকার ‘ভূয়া’ বিল

একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম ২৪ হাজার টাকা!

২০২২ ফেব্রুয়ারি ০৩ ১৮:৪৩:০৯
একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম ২৪ হাজার টাকা!

প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট : কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রমে ১২লক্ষাধিক টাকার আপ্যায়ন বিল উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃপঃ কর্মকর্তা ডাঃ মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল এর বিরুদ্ধে। ৮/৯মাস পূর্বে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লোকজন স্বাক্ষর ও লেখা বিহীন লাগোয়া মরিয়ম হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট নামের একটি গ্রামীণ চা-জিলাপী-সিঙ্গারার দোকান থেকে ২’শ টি ফাঁকা ভাউচার নিয়ে গিয়ে এ বিল করছেন। ফাঁকা ভাউচার নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি  নিশ্চিত করেছেন মরিয়ম হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের মালিক মোঃ মুকুল বকসী। ওই ফাঁকা ভাউচারগুলো তারা কি কাজে ব্যবহার করেছেন তাও জানা নেই তার। তবে তারা কয়েকদিন ভাত-নাস্তা নিয়ে গেছেন এবং এক বছরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লাখ খানেক টাকার ভাত-নাস্তা সরবরাহ করেছেন বলে জানান। তিনি আরও দাবি করেন, তার দোকান ছোট। গ্রামীণ দোকান। তার কোন ভ্যাট রেজিষ্ট্রেশনের কাগজ নেই। তিনি কোন ভ্যাটও দেন না। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে,সমস্ত ভাউচার গুলো একই হাতের লেখা এবং প্রত্যেকটি ভাউচারে পুরো অংকের টাকা লেখা হয়েছে। তবে কি মালামাল ক্রয় করা হয়েছে তার কোন বর্ননা নেই। ভাউচারগুলো দিয়ে বিগত ২০২১ সালের ৩ জুন তারিখে রাজারহাট হিসাবরক্ষণ অফিসে বিল দাখিল করা হয় এবং যথারীতি বিলের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। হিসাব রক্ষণ অফিসের এ সংক্রান্ত কয়েকটি বিল নম্বর হচ্ছে -১,২,৩,৪,৫,৬,১৬,১৭/২০-২১। এছাড়া গত এক বছরের মধ্যে এপ্লাস ক্যাম্পেইন সহ বিভিন্ন কর্মসূচীতে আপ্যায়নের নামে আরো কয়েক লক্ষ টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, ওই কর্মসূচী সহ কয়েকটি কর্মসূচীতে বিগত ২০২০-২০২১ এবং চলতি ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের এ সময় পর্যন্ত অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করা হলেও কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ২০২১ সালের ২৮ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১মে পর্যন্ত সময়ে ৬ দিনে ৭৮টি ভাউচারের মাধ্যমে ১২ লাখ ১৬ হাজার ৮০০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে ২০২১ সালের ২৮ফেব্রুয়ারি ২১ হাজার ৬০০ টাকা করে ১৩টি ভাউচার, ১৫মার্চ ১৫ হাজার ৬০০ টাকা করে ১৩টি, ৩১ মার্চ ১৪ হাজার ৪০০ টাকা করে ১৩টি, ১৫এপ্রিল ১৪ হাজার ৪০০টাকা করে ১৩টি, ১৮মে ১৫হাজার ৬০০ টাকা করে ১৩টি এবং ৩১মে ১২ হাজার টাকা করে ১৩টি ভাউচারে ব্যয় দেখিয়ে উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিস থেকে এসব বিল উত্তোলন করা হয়েছে। ওই সময় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্ের টিকাদান কার্যক্রমে অংশ গ্রহনকারীদের একদিন ৪০জনের ৪০প্যাকেট খাবারের মূল্য ২০হাজার টাকা দেখিয়েও একটি বিল উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

শুধু আপ্যায়ন বিল নয়। ভ্যাকসিন ও লজিষ্টিকস পরিবহন ব্যয়,কোভিড-১৯টিকাদান কাজে নিয়োজিতদের ভ্রমন ব্যয়,টিকাদান কার্যক্রমে অনিয়মিত শ্রমিকের মজুরী বিল, জাতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন-২১ উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবক ও মাঠকর্মীগণের ভাতা, মালামাল পরিবহন, স্যানিটাইজার ক্রয়, পোর্টারের মজুরী বিল,সমন্বিত পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ষ্টেশনারী মালামাল ক্রয়, পাবলিক এ্যাড্রেস সিস্টেম, শিশু বান্ধব হাসপাতাল প্রশিক্ষানাথীদের ভাতা, সার্টিফিকেট ব্যানার তৈরী, ভূয়া স্বাক্ষরে স্বেচ্ছা সেবক ও সাপোর্ট স্টাফগণের ভাতা,হাসপাতালের বজ্য অপসারণ সহ বিভিন্ন খাতে, বিভিন্ন সভা, কর্মশালা, স্যানিটাইজার, ভ্রমণসহ বিভিন্ন খাতে ভূয়া ভাউচারে কয়েকগুন বাড়িয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিল সহ এভাবে বিভিন্ন কর্মকান্ডে অনিয়ম-দূর্নীতির ভয়ংকর তথ্য পাওয়া গেছে রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পঃপঃ কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল এর বিরুদ্ধে। এসব বিলের বেশিরভাগে নেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাব শাখার কর্মকর্তার স্বাক্ষর।

এদিকে সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে মাদার সাপোর্ট ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত হয়। দু’দিনের প্রশিক্ষণে ৮০জন করে নারী অংশ গ্রহণ করেন। উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের মহিধর কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্ব প্রাপ্ত ইউএইচসিপি পারভীন বেগম জানান,উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্র কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণার্থীদের মাথাপিচু ৩০টাকা হারে আপ্যায়ন ব্যয় দিয়েছেন। এছাড়া ক্লিনিকের দায়িত্বরত ইউএইচসিপি পারভীন বেগম ৬০০টাকা হারে দু’দিনের সম্মানীভাতা (অন্যান্য খরচ কর্তনের পর) পেয়েছেন বলে জানান। ওরিয়েন্টেশনে অংশ গ্রহনকারী বা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে আর কোন সরকারি সহায়তা কিংবা ষ্টেশনারী, মনোহরি বা ব্যানার প্রদান করা হয়নি।

একই কথা জানিয়েছেন পার্শ্ববর্তী রামকার্জী কমিউনিটি ক্লিনিকের ইউএইচসিপি তপন পাল, উপজেলার তালুক সোনাবর ক্লিনিকের ই্উএইচসিপি রোমানা ফেরদৌস,দেবীচরন কমিউনিটি ক্লিনিকের ইউএইচসিপি আহসান হাবিব, পোদ্দারপাড়া ইউএইচসিপি শাহজালাল,দুধখাওয়া ইউএইচসিপি আশরাফুল হক সহ অন্যান্য ক্লিনিকের ইউএইচসিপিগণ। অথচ গত জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে ১/২১-২২ নম্বর বিলের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকে মাদার সাপোর্ট গ্রুপের ওরিয়েন্টেশনে ফেসিলেটর ইউএইচসিপি ও সাপোর্ট ষ্টাফ গণের সম্মানী ভাতা ভ্যাট কর্তনের পর ৩লাখ ৪৪হাজার ৯৭৬টাকা,২/২১-২২ নম্বর বিলে ওরিয়েন্টেশনের প্রশিক্ষানার্থীগণের ষ্টেশনারী ক্রয় বিল ২লাখ ৩৬হাজার ৬০টাকা,৩/২১-২২নম্বর বিলে প্রশিক্ষনার্থীগণের আপ্যায়ন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৪৮টাকা, ৪/২১-২২ বিল নম্বর বিলের মাধ্যমে ৪৯হাজার ৩০০টাকা সহ ৮লাখ ১৯হাজার ১৮৪টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

একইভাবে ২০২১ইং সনের ২৪ জুন তারিখ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে কোভিড-১৯ নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারনার ব্যয় দেখিয়ে ভূয়া ভাউচারে ১লাখ ৬৮হাজার টাকা ১টি,আলোচনা সভার আপ্যায়ন ব্যয়ের নামে ৩৯হাজার ২০০টাকার ১টি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্রয় দেখিয়ে ২৪হাজার টাকার ১টি বিল উপজেলা হিসাব রক্ষন অফিস থেকে উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। একই সময় কোভিড-১৯ রোগীর নমূনা সংগ্রহ ও জেলায় প্রেরন এর পরিবহন ব্যয় দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ৬১হাজার ৮০০টাকার পৃথক বিল।

অন্যদিকে ৭জুন ২০২১ইং ভ্যাকসিন পরিবহন ব্যয় দেখিয়ে ৪২হাজার টাকার ১টি,৩৬হাজার ৪০০টাকার ১টি,৮০হাজার ৫০০টাকার ১টি,৮৪হাজার টাকার ১টি সহ বিভিন্ন সময় পরিবহন ব্যয়ের নামে কয়েক লক্ষাধিক টাকার বিল উত্তোলন করা হলেও উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্ব প্রাপ্তগণ দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য।

তারা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সহ অন্যান্য সকল প্রকার ভ্যাকসিন টিকাদান কেন্দ্র গুলোতে ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারের মাধ্যমে বহন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থনৈতিক কোড-৩২৫৮১০৫ এর আওতায় এ্যাম্বুলেন্স মেরামত ও বিভিন্ন বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০২০-২১ইং অর্থবছরে তিন লক্ষ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে তাও বলতে পারেননা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্যানা কর্মচারীরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আবুল কালাম জানান,গত এক বছরে তার এ্যাম্বুলেন্সের কোন মেরামত বা যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়নি। কোভিড-১৯রোগীদের নমূনা সংগ্রহ ও জেলায় প্রেরনের ব্যয় দেখিয়ে অনেক টাকা বিল উত্তোলন করা হলেও মূলতঃ সমস্ত নমূনা ভ্যাকসিন ক্যারিয়ারে করে স্বাস্থ্য কর্মীরা মোটর সাইকেলে বহন করে জেলায় প্রেরন করতো বলে তিনি জানান। একই ভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্েরর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা খাতে (বরাদ্দ অর্থনৈতিক কোড-৩২১১১০২) বরাদ্দকৃত টাকার অধিকাংশই ভূয়া ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করে আতœসাতের অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবিকা শান্তি রায় বলেন, কোভিড-১৯, ভিটামিন এ প্লাস বা অন্যান্য অন্যান্য কর্মসূচীর জন্য তিনি কোন ভাতা পাননি । একই কথা জানান সেবিকা তীর্থ রানী,নেওয়াজ সেলিনা সহ অন্যারা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান হিসাব রক্ষক কাম অফিস সহকারি আশরাফুল ইসলাম জানান, কোভিড-১৯ কার্যক্রমের বিলগুলো আমার যোগদানের পূর্বের। মাদার সাপোর্ট ওরিয়েন্টেশনের বিলগুলোও আমার মাধ্যমে তৈরী করা হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা কার মাধ্যমে বিল তৈরী করিয়েছেন তা আমার জানা নেই। একই কথা বলেছেন, রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক হিসাব রক্ষক কাম অফিস সহকারী (বর্তমানে কুড়িগ্রাম সরকারি হাসপাতালে কর্মরত) আব্দুর রাজ্জাক। তাকে দিয়েও কোভিড-১৯ কার্যক্রমের বিল তৈরী করা হয়নি বলে তিনি জানান।

এ প্রসঙ্গে রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, কাজ করলে কিছু ভূল থাকবে। বিল ভাউচারে দু’একটা ত্রুটি থাকতে পারে। হিসাব সহাকারী দিয়ে বিল না করার অভিযোগে বলেন, সবাই সব কাজ করতে পারে না। যে পারে তাকে দিয়ে করানো হয়। ভুয়া ভাউচারের বিষয়ে বলেন আমাদের লোকজন এগুলো লেখে। দোকানদাররা তো বোঝেনা।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ড. মনজুর এ-মোর্শেদ বলেন, আমি কিছুদিন আগে এখানে যোগদান করেছি। রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যে বিষয়গুলোর খোঁজ খবর নিয়ে অভিযোগ সত্য হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(পিএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test